বদর যুদ্ধ: সাধারণ সদস্যের অভিনব প্রস্তাবে মুসলিমদের জয় আসে যেভাবে
ধর্ম
বদর যুদ্ধ: সাধারণ সদস্যের অভিনব প্রস্তাবে মুসলিমদের জয় আসে যেভাবে
লোকটার নাম আসওয়াদ ইবনে আবদুল আছাদ মাখযুমি। দুর্বৃত্ত এবং অসচ্চরিত্রের লোক হিসেবে তাকে চেনে সবাই। কুরাইশদের পক্ষ থেকে সে ময়দানে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিলো, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছি, ওদের জলাশয়ের পানি আমি পান করেই ছাড়বো। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউজকে ধ্বংস বা তার জন্য জীবন দিয়ে দেবো। আসওয়াদকে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষ অর্থাৎ রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে এগিয়ে এলেন হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব। দুজনের দেখা হলো জলাশয়ের কাছেই। চরম আঘাতটা প্রথম হানলেন হযরত হামযা (রাঃ) - ই। 
বদর যুদ্ধ © pinterest
বদর যুদ্ধ © pinterest
তলোয়ার দিয়ে আসওয়াদ’কে এমনভাবে আঘাত করলেন যে তার পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অবিরাম রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়ার মধ্যেই সে চেষ্টা করতে থাকলো তার কসম পূর্ণ করার। সে কি পেরেছিল জলাশয়ের পানি পান করতে? সময়টা দ্বিতীয় হিজরি। রমজান মাসে কুরাইশদের একটি সুবিশাল বাণিজ্য কাফেলা বিপুল অর্থ-সম্পদ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র ক্রয় করে সিরিয়া থেকে ফিরছিল। রাসূল (সাঃ) সাহাবীদেরকে কুরাইশদের বানিজ্য কাফেলার গতিরোধের জন্য বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ানের ভয় ছিল মুসলমানরা এগুলো তাদের থেকে ছিনিয়ে নেবে। কেননা কুরাইশরা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের মাঝে কোনো প্রকার চুক্তি ছিল না। আর কাফির কুরাইশরা মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ হতে বের করে দিয়েছিল এবং ইসলামের সত্যবাণীর দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাই সুফিয়ান মক্কায় খবর পাঠালেন যে তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। 
বদর যুদ্ধ © wikimedia commens
বদর যুদ্ধ © wikimedia commens
আবু সুফিয়ানের সাহায্যের খবর মক্কায় পৌঁছালে কুরাইশরা এক হাজার সদস্যের বিশাল সেনাদল নিয়ে মুসলমানদের মোকাবেলায় বেরিয়ে পড়ল। আবু জেহেল সহ কোরাইশদের বড় বড় নেতারা ১০০ ঘোড়া আর ৭০০ উট নিয়ে সুফিয়ানের দলের সাথে যোগ দিতে রওয়ানা হলো। তাদের সঙ্গে ছিলো নর্তকী দল, যারা মুসলিমদের বদনামি ও বিদ্রূপ করে গান গাইছিলো। রাসূল (সাঃ) তিন শতাধিক সাহাবীকে নিয়ে বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাদের ছিল কেবলমাত্র দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট; যাতে তারা পালাক্রমে চড়ছিলেন। এ লড়াইয়ে ৭০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর দল অবশ্য বানিজ্য কাফেলা ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চান নি। কিন্তু পরিস্থিতির আবেদন ছিল অন্যকিছু!  কুরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান চলার পথে যাকেই পেত, মুসলমানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত। বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই সে তার কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হয়, মুসলমানদের খবর নেয়। একসময় আবু সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমুদ্র উপকূল ধরে রওয়ানা দিল এবং নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। আবু সুফিয়ান যখন কুরাইশদের যাত্রার কথা জানতে পারল, তখন সে নিজের নিরাপদে ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে কুরাইশদের যুদ্ধ ছাড়াই ফিরে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধ ছাড়া পিছু ফিরে যেতে অস্বীকার করল। আবূ জেহেল বলল, “আল্লাহর শপথ, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বদর প্রান্তরে না পৌঁছব ততক্ষণ ফিরে যাব না। আমরা বদর প্রান্তরে তিনদিন অবস্থান করব। তথায় উট জবাই করব, খাদ্য খাব, মদ পান করব আর তাতে আরব জাতি আমাদের গৌবরগাথা শুনে সর্বদা ভয় পাবে”। বদরের পূর্ণ নাম বদর হুনায়ন। সৌদি আরবের আল মদিনা প্রদেশের একটি শহর এটি। মদিনা থেকে প্রায় ১৩০ কি.মি দূরে অবস্থান বদরের।


বদর যুদ্ধে শহীদ মুসলিমদের তালিকা © Islamic landmarks
বদর যুদ্ধে শহীদ মুসলিমদের তালিকা © Islamic landmarks
নবীজি (সা.) তাদের সম্পর্কে জানতে পেরে সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন।  পরামর্শ সভা শেষে নবীজি (সা.) বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন। বদর কূপসমূহের কাছের পানির কূপের সম্মুখে যাত্রাবিরতি দিলেন। এই যাত্রাবিরতি ছিল যুদ্ধ সংক্রান্ত কৌশল ও সিদ্ধান্তের অংশ। দলটির সদস্য হুবাব (রাঃ) এই স্থানটি 'উপযুক্ত নয়' মত দিয়ে প্রস্তাব করলেন কুরাইশদের নিকটবর্তী কূপের নিকট অবস্থানের। বললেন, " সেখানে আমরা অবস্থান করব এবং এর পিছনের কূপগুলো নষ্ট করব। অতঃপর সে কূপের কাছে হাউজ বানিয়ে তা পানি দিয়ে পূর্ণ করে রাখব, ফলে আমরা পানি পান করব অথচ তারা পানি পান করতে পারবে না।" প্রস্তাবটি রাসূল (সাঃ) পছন্দ করলেন। এরপর তারা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনা ও উপত্যকার দিক থেকে নিকটবর্তী ‘উদওয়াতুদ দুনিয়া’তে অবতরণ করলেন, অন্য দিকে কুরাইশরা মক্কার দিক থেকে কাছে এবং উপত্যকা থেকে দূরে ‘উদওয়াতুল কুসওয়া’তে অবস্থান করল। ওই রাতেই আল্লাহ তা‘আলা এমন মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন যা কাফিরদের জন্য বিরাট বিপদ ও দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাদের মাটি কাদা ও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। ফলে তারা সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। অপরদিকে বৃষ্টি মুসলিমদের জন্য খুব হাল্কা ছিল ফলে তা তাদেরকে পবিত্র করল এবং তাদের যমীনকে চলাচল উপযোগী করে দিল, বালুকে শক্ত করল, অবস্থানকে অনুকুল করল। 


রাত অতিবাহিত হয়ে সকাল এলো। ভোরে কুরাইশদের একটি দল রাসূল (সাঃ) এর হাউজের দিকে অগ্রসর হলো। নবীজি দলটির উপর আক্রমণ করতে বারণ করলেন। কুরাইশদের দলটি হাউজ থেকে পানি পান করল এবং পরবর্তীতে যুদ্ধে নিহত হল। কিন্তু হাকেম সেই পানি পান করেনি। সে বেঁচে গেল। পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বদরের প্রান্তে যুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে প্রথম ইন্ধনদাতা হিসেবে বলা হয়ে থাকে আসওয়াদ ইবনে আবদুল আছাদ মাখযুমির নাম। কুরাইশদের পক্ষ থেকে সে ময়দানে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিলো, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছি, ওদের জলাশয়ের পানি আমি পান করেই ছাড়বো। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউজকে ধ্বংস বা তার জন্য জীবন দিয়ে দেবো। আসওয়াদকে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষ অর্থাৎ রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে এগিয়ে এলেন হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব। দুজনের দেখা হলো জলাশয়ের কাছেই। চরম আঘাতটা প্রথম হানলেন হযরত হামযা (রাঃ) - ই। তলোয়ার দিয়ে আসওয়াদ’কে এমনভাবে আঘাত করলেন যে তার পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অবিরাম রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়ার মধ্যেই সে চেষ্টা করতে থাকলো তার কসম পূর্ণ করার। কিন্তু পারলো না সে। হযরত হামযা (রাঃ) আবারও আঘাত করলেন আসওয়াদকে। আঘাতের ফলে সেই জলাশয়ে পড়েই মারা গেল সে।  
বদর প্রান্তর © Wikipedia
বদর প্রান্তর © Wikipedia
কুরাইশদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। লড়াইয়ে নামলেন মুসলিমরাও। তুমুল লড়াই চললো। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারাও মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। কুরাইশদের পক্ষে বেশ ধরে যুদ্ধে ছিলেন অভিশপ্ত ইবলিশও। কিন্তু পরাজয় আসন্ন জেনে সে যুদ্ধের শেষদিকে সমুদ্রে গিয়ে আত্মগোপন করলো। কুরাইশদের অনেক কাফের যোদ্ধারা মুসলমানদের হাতে বন্দি হল। প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুসলমান যোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয় সুসজ্জিত বিশাল কুরাইশ বাহিনী।
এই যুদ্ধে মুসলমানদের ১৪ জন সাহাবি যোদ্ধা শহিদ হন।  কুরাইশদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন কাফের যোদ্ধা মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। যাদের অধিকাংশই নেতা পর্যায়ের লোক ছিল।  বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হজরত ওমর, হজরত আলি ও হজরত আমির হামজা (রা.)। আর কুরাইশদের মধ্যে নেতত্ব দিয়েছিল আবু জাহেল, উৎবা, শায়বা ও পতাকাবাহী নজর ইবনে হারেশ, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা এবং আবু সুফিয়ান।
বদর প্রান্তর © Islamic landmarks
বদর প্রান্তর © Islamic landmarks
এ যুদ্ধে কুরাইশদের ২৪ জন সেনাপ্রধান নিহন হয়। কুরাইশদের প্রধান সেনাপতি আবু জেহলকে হত্যা করেন দুজন সহোদর আনসার কিশোর সাহাবি হজরত মাআজ ও মুআজ (রা.)। নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ শেষে বদর প্রান্তরে মুসলমানরা ৩ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন, চতুর্থ দিনে নবীজি (সা.) সবাইকে নিয়ে মদিনার পথে রওনা করেন। তাঁর সাথে ছিল বন্দি কুরাইশরা এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। যুদ্ধ বন্দিদের ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) বিনিময় বা মুক্তিপণ গ্রহণ করলেন। তাদের বিনিময়ের পরিমাণ ছিল এক থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। আর তাদের কেউ কেউ মদীনায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা করানোর মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করল। কেউ মুক্তি পেল কুরাইশের কাছে বন্দি মুসলিমের মুক্তির বিনিময়ে। আবার কাউকে মুসলিমদের প্রতি কঠিন কষ্টদায়ক আচরনের কারণে হত্যা করা হলো। আবার কাউকে তিনি বিশেষ স্বার্থের কারণে দয়া করে বিনা বিনিময়েই মুক্ত করে দিলেন। যুদ্ধবন্ধীদের সাথে আল্লাহর নবী ও মুসলিমরা যে সহমর্মিতা দেখান বিশ্বের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া মুশকিল। এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের অর্জন ছিল- আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি, বিশ্ব জয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস রচনা। আল্লাহ এ দিবসকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণের দিন বলে নাম রেখেছেন; কেননা আল্লাহ সেদিন তাঁর রাসূল (সাঃ) ও মুমিনদের বিজয়ী এবং কাফির ও মুশরিকদের পরাজিত করার মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের পার্থক্য সূচিত করেছেন। 


ধর্মইসলামসৌদি আরবইতিহাস
আরো পড়ুন