আন্তর্জাতিক
হিরু ওনোদা: বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও ২৯ বছর জঙ্গলে থেকে লড়েছেন যে সেনা!
ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে ১৯৭৪ সালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন একজন জাপানি সৈনিক। জানা যায়, তখনও আরেকজন জাপানি সৈনিক লড়াই করছেন দ্বীপে। অবশ্য ফিলিপাইনের সঙ্গে তখন জাপানের বৈদেশিক সম্পর্ক বেশ ভালোই। জাপানও তখন ফিলিপাইনে সেনা মোতায়েন করেনি। কিন্তু জাপানি সৈনিকরা তখনও লড়ে যাচ্ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্য। কি অবাক হচ্ছেন! সত্যিই এমনটি ঘটেছিল জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে।

লুবাং দ্বীপের জঙ্গলে হেঁটে যাচ্ছেন হিরু ওনোদা
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার ২৯ বছর পরেও তারা লড়ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্যই! তাদেরই একজন জাপানের সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোদা। যাকে ১৯৫৯ সালে সরকারিভাবে ‘মৃত’ ঘোষণা করে তৎকালীন জাপান সরকার। তবে হিরুর সন্ধান চালিয়ে যাওয়া এক ছাত্র নোরিয়ো সুজুকি ১৯৭৪ সালে হিরুকে খুঁজে পান। ওই জঙ্গলেই ২৯ বছর ধরে লড়ে চলেছিলেন এই বীর সেনা। ফিলিপাইনের জঙ্গল থেকে জাপানে ফেরার জন্য আবেদন-নিবেদন করলেও সুজুকির কথায় কর্ণপাত করেননি হিরু।
এমনকি সেই ১৯৭৪ সালেও তার বিশ্বাস হয়নি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে। তখনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন হিরু। ১৯৪২ সালে জাপানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন হিরু। দুই বছর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে তাকে ফিলিপাইনে পাঠানো হয়েছিল। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার হিরুকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, ওই জঙ্গলে ঘাঁটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে। বলা হয়েছিল, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শেষ নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে। সেটাই করেছিলেন হিরু।

নোরিও সুজুকির সাথে হিরু ওনোদা; সুজুকির হাতে ধরা ওনোদার রাইফেল
১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ফিলিপাইনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে লুবাং দ্বীপের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছিলেন হিরু। ম্যানিলা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরের ওই দ্বীপে শুরুতে তার সঙ্গে আরও তিন জন জাপানি সেনাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন। একে একে তারা মারা যান। কর্তব্যপালনে একাই জঙ্গলে থেকে যান হিরু। রোগাপাতলা চেহারার ২২ বছরের হিরুর সঙ্গী বলতে ছিল একটি রাইফেল এবং তলোয়ার। গেরিলা যুদ্ধে সিদ্ধহস্ত হিরু সেই তলোয়ারে নিয়মিত শান দিতেন। মনে করেছিলেন, এসব শত্রুপক্ষের প্রচারকৌশল। যুদ্ধশেষে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনের তল্লাশি দলের সদস্য থেকে দ্বীপের বাসিন্দাদের আক্রমণও করতেন তিনি। জঙ্গলে থাকাকালীন অন্তত ৩০ জন স্থানীয় বাসিন্দাকে হত্যা করেছিলেন হিরু। তার ধারণা ছিল, ওই বাসিন্দারা আসলে শত্রুপক্ষের সেনা। ১৯৫০ সালে ফিলিপাইনে সেনাবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেন হিরুর সঙ্গী। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক গোষ্ঠীত্যাগী ভেবে বাকি দু’জনকে যথাক্রমে ১৯৫৪ এবং ১৯৭২ সালে গুলি করে মেরে ফেলে ফিলিপাইনের পুলিশ।
হিরুকে ফিলিপাইনে পাঠানোর সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিন বছর লাগতে পারে, পাঁচ বছরও লাগতে পারে। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা তোমাকে দেশে নিয়ে যেতে আসব।
পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে সরকারিভাবে হিরুর মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে গেলেও তা মানতে নারাজ ছিলেন জাপানি ছাত্র সুজুকি। হিরুর খোঁজে তিনি ফিলিপাইনের ওই দ্বীপে পৌঁছে যান। শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে বেরও করেন। এর পর শুরু হয় হিরুকে দেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা। তবে সুজুকির কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। তার মনে ছিল ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির কথা।

মার্কিন সেনাবাহিনীর দাপটে জাপান কোণঠাসা হয়ে পড়লে হিরুকে একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মেজর ইয়োশিমি তানিগুচি। হিরুকে ফিলিপাইনে পাঠানোর সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিন বছর লাগতে পারে, পাঁচ বছরও লাগতে পারে। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা তোমাকে দেশে নিয়ে যেতে আসব। হিরুকে দেশে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে জাপানে ফিরে গিয়েছিলেন সুজুকি। সঙ্গে ছিল হিরুর বহু ছবি। সেসব প্রমাণ দেখে হিরুকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ওই দ্বীপে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল জাপান সরকার। সে দলে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর তানিগুচি। ২৯ বছর পর হিরুর মুখোমুখি হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। সেনা থেকে অবসরের পর পেশায় তিনি তখন বই বিক্রেতা।

লুবাং দ্বীপ
লুবাং দ্বীপে পৌঁছে নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। প্রায় তিন দশক পরেও ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্যের অভাব ছিল না হিরুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের খবর দিয়ে হিরুকে তার কর্তব্য থেকে মুক্ত করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে দেখামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন হিরু। তবে ছেঁড়াফাটা উর্দিতে ঊর্ধ্বতনকে সালাম ঠুকতে ভুল করেননি। ১৯৭৪ সালের মার্চে জাপানে ফেরার পর রাজকীয় সম্মান জুটেছিল হিরুর। শোভাযাত্রা করে স্বাগত জানানোর পর তাকে বীরের সংবর্ধনা দিয়েছিল দেশবাসী। যাবতীয় অনুষ্ঠান শেষে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়েছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, এত বছর ধরে জঙ্গলে কাটানোর পরেও আশ্চর্যজনকভাবে সুস্থ রয়েছেন হিরু।
প্রায় তিন দশক ধরে জঙ্গলে থাকাকালীন কী চিন্তাভাবনা চলত তার মনে? হিরু বলেছেন, 'কিছুই না। শুধু নিজের কর্তব্য পালন করার কথাই ভাবতাম।'
কর্তব্যনিষ্ঠার যে প্রমাণ দিয়েছিলেন হিরু, তাতে রাতারাতি জাতীয় নায়ক হয়ে যান তিনি। তার কাহিনি শুনতে উদ্গ্রীব ছিল আমজনতা। ১৯৭৪ সালে দেশে ফেরার পর সে কাহিনি নিজের লেখনীতে জানানোর জন্য বরাতও পেয়ে যান হিরু। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পেনশনের পাশাপাশি স্মৃতিকথা লেখার জন্য এক লাখ ৬০ হাজার ডলারের চুক্তি হাতে পেয়ে যান তিনি। সে বছরেই ‘নো সারেন্ডার: মাই থার্টি-ইয়ার ওয়ার’ নামে এক স্মৃতিকথা লিখে ফেলেন হিরু। যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দুনিয়ায়। প্রতিবেদন, বইয়ের পাতা থেকে তথ্যচিত্রে জায়গা করে নেয় হিরুর কাহিনি। যদিও ঝাঁ-চকচকে জাপানের জীবনযাত্রার সঙ্গে বেশি দিন খাপ খাওয়াতে পারেননি হিরু। নিজের দেশ ছেড়ে ১৯৭৫ সালে ব্রাজিল চলে যান তিনি। সে দেশে কৃষিকাজ করতেন। তবে ১৯৮৪ সালে আবার জাপানে ফিরে যান। এর পর জাপান জুড়ে ‘নেচার ক্যাম্প’ খুলেছিলেন।
আরও একটি সুখবর এসেছিল হিরুর জীবনে। ফিলিপাইনে থাকাকালীন যে ৩০ জনকে হত্যায় দায়ী ছিলেন হিরু, সে অপরাধ মাফ করে দিয়েছিলেন সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস। প্রেসিডেন্টের কাছে প্রথাগতভাবে আত্মসমর্পণ করার সময় হিরুর পরনে ছিল সেই ৩০ বছরের পুরনো উর্দি, টুপি এবং তলোয়ার।

টোকিওতে পৌঁছে স্বদেশবাসীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন হিরু ওনোদা
সব কিছুরই বেশ যত্ন নিয়েছিলেন হিরু। ২০২১ সালে চলচ্চিত্রের পর্দায় জায়গা করে নিয়েছিলেন হিরু। ‘ওনোদা: ১০,০০০ নাইটস ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে একটি ফরাসি ছবিতে দেখা গিয়েছিল হিরুর কাহিনি। বাস্তব এবং পর্দা দুটিতেই নায়কের ভূমিকা নিলেও সেনাবাহিনীর শিক্ষা আজীবন মনে রেখেছিলেন হিরু। তিনি বলেন, 'আমি সৌভাগ্যবান যে কম বয়সে কর্তব্যপালনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছি।' প্রায় তিন দশক ধরে জঙ্গলে থাকাকালীন কী চিন্তাভাবনা চলত তার মনে? হিরু বলেছেন, 'কিছুই না। শুধু নিজের কর্তব্য পালন করার কথাই ভাবতাম।'