জাতীয়
নানাবিধ সংকটে সাংবাদিকতা, সমাধান জরুরি!
শিক্ষকতায় যোগদান করার পরপরই বিভাগে একটা নতুন কোর্স পড়ানো শুরু করি। যতদূর জানি বাংলাদেশের কোন সাংবাদিকতা বিভাগে এই কোর্সটি পড়ানো হয় না। আমার মাধ্যমেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর-এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রথম যাত্রা শুরু হয় কোর্সটির। এই কোর্সের নাম "Safety and Security of Journalists"। কোর্সটির উল্লেখ করলাম এজন্য যে যাতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কোর্সটি পড়ানো হয়। সাংবাদিকতার ভেতরের খবর জানার জন্যও কোর্সটি খুবই জরুরি। সারাবিশ্বে সাংবাদিকতা যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তাতে এই কোর্স আরো দরকারি হয়ে পড়েছে বর্তমানে। নিজেকে রক্ষার ও সুরক্ষার কৌশলগুলো জানাও আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। কারণ সাংবাদিকতা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা - তা অফলাইন ও অনলাইন উভয় ক্ষেত্রেই।

এই কোর্সে সাংবাদিকদের আর্থিক, শারীরিক, মানসিক নিরাপত্তা, ঝুঁকি, ও এসবের সুরক্ষা কৌশল প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করি। সাংবাদিকদের আইনী ঝুঁকি মোকাবেলা, যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, হামলা-মামলাসহ সাংবাদিকদের এসবক্ষেত্র ও ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণাধর্মী পর্যালোচনা করি। এরফলে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকতার এপিট-ওপিট সবকিছু জানতে পারে। এসব ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার কৌশলগুলোও জানতে পারে। আমি যেহেতু সাংবাদিকতার প্র্যাকটিক্যাল জগৎ থেকে আসা সেহেতু সাংবাদিকতার ভালো দিক, মন্দ দিক, সংবাদ জগতের ভেতরের খবর খুঁটিনাটি সব দিক জানাই শিক্ষার্থীদের। সাংবাদিকের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বকাঠামোও পঠন-পাঠনের অর্ন্তভুক্ত করা হয়। ভেতরের এবং বাইরের সবকিছু জেনে-শুনে শিক্ষার্থীরা এখন আর সাংবাদিকতা করতে চাইবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতে সাংবাদিকতার আর্থিক তেমন কোন নিরাপত্তা নেই হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ছাড়া। চাকরির নিরাপত্তা নেই সাংবাদিকদের।
ভেতরের এবং বাইরের সবকিছু জেনে-শুনে শিক্ষার্থীরা এখন আর সাংবাদিকতা করতে চাইবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতে সাংবাদিকতার আর্থিক তেমন কোন নিরাপত্তা নেই হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ছাড়া। চাকরির নিরাপত্তা নেই সাংবাদিকদের।
এরপর বিভিন্ন ভীতিকর পরিস্থিতি যেমন হামলা-মামলা এসব হলে জেনে-শুনে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা আর সাংবাদিকতা করবে না। আমার এক ছাত্রকে গবেষণা করিয়ে দেখেছি বেশিরভাগ সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা করতে চায় না। অন্যদিকে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সংকটে থাকায় পেশাদার সাংবাদিকগণ সাংবাদিকতা ছেড়ে দিচ্ছেন বা দিবেন। অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা। আবার মধ্যবয়সে অনেক সিনিয়র সাংবাদিক চাকরি হারাচ্ছেন। ফলে সাংবাদিকতা দখল করছে টাউট-বাটপার টাইপের লোকজন। ইতোমধ্যেই প্রবেশ করতে শুরু করেছে এরা। নীতি-নৈতিকতা এদের কাছে মঙ্গল গ্রহের কোন বস্তু। প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকগণ এখন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন এসব টাউট সাংবাদিকতার ছোবলে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সংকটের কারণে বা কোন রকমে একটা মিডিয়া পালতে হবে মনে করে কম বেতনে সাংবাদিক-সংবাদ ব্যবস্থাপক রাখছে। ফলে যা সংবাদযোগ্য নয়, বা নৈতিকতার মানদন্ডে পড়ে না এমন বক্তব্য-বিবৃতি, তথ্য, বা ফেক নিউজ গণমাধ্যমে ঢুকে পড়ছে, প্রচারিত বা প্রকাশিত হচ্ছে। পেশাদার গেটকিপিং হচ্ছে না।
সাংবাদিকতায় ভুল সবসময়ই হয়, কিন্তু আগেকার দিনের ভুল হলে ভাইরাল হতো না, এখন ভুল হলে মাফ নেই- তা ভাইরাল হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। প্রেস কাউন্সিলে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এখন কেউ অভিযোগ দিতে যায় না। কিন্তু আইন, হামলা-মামলা-গ্রেফতার সমাধান নয়, সমাধান সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব বিনির্মাণে ও জোরদারকরণে। পেশাদারিত্বের চর্চার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের আর্থিক সংকট দূরীভুতকরণ যাতে করে ভালো দক্ষ লোকজন পেশায় থাকে বা প্রবেশ করে। এজন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতাও জরুরি। এই পৃষ্ঠপোষকতা যেমন হতে পারে অর্থগত বিষয়ে, তেমনি প্রয়োজন স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রেও। এসব সংকট জরুরিভাবে মেকাবেলা করা দরকার সকল পক্ষ মিলে। সরকার, সাংবাদিক, সাংবাদিক ইউনিয়ন, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান সম্মিলতভাবে। তা না হলে রাষ্ট্রর চতুর্থ স্তম্ভটি বিলীন হয়ে পড়বে। সাংবাদিকতার চিরায়ত অবয়ব আর থাকবে না। এ অবস্থা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্র, সরকার, গণমাধ্যম ও ব্যক্তি-সমাজ সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে।
টিপ্পনী
যোগাযোগ ডিসিপ্লিনের একটা বিষযক্ষেত্র সাংবাদিকতা। এর আরো অধি-বিষয়ক্ষেত্র রয়েছে যেমন উন্নয়ন যোগাযোগ, জনসংযোগ, বিজ্ঞাপনকলা প্রভৃতি। অনেকের মনে হতে পারে তাহলে এই বিভাগ রাখার দরকারবা কী? সাংবাদিকতার দক্ষতার ক্ষেত্রসমূহ যেমন সম্পাদনা, ফটোগ্রাফি-ভিডিওগ্রাফি, রিপোর্টিং প্রভৃতি বর্তমান যুগে সকলক্ষেত্রেই প্রয়োজন। সাংবাদিকতা ছাড়া উপরের অধিক্ষেত্রগুলোর জন্যও প্রস্তুত করা হয় আমাদের শিক্ষার্থীদের।
লেখক: মাহামুদুল হক, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ।