প্রযুক্তি
ভারতের চন্দ্র জয় কেন গুরুত্বপূর্ণ
রহস্যময় মিষ্টি আলোর চাঁদ নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই আদিকাল থেকেই। পৃথিবী নামক গ্রহের একমাত্র এই উপগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা প্রশ্নের উত্তর খুজেঁছেন এবং এখনো খুঁজে চলছেন। এই চাঁদ কবি আর সাহিত্য প্রেমিকদের করেছে কল্পনাপিয়াসী, আবার চাঁদের চরকা কাটা বুড়ির গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছে কত শিশু। বলা যায় অনন্ত মহাবিশ্বে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলো চাঁদ। অবশ্য পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরের এই চাঁদ অনেক আগেই জয় করেছে মানুষ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা-২ মিশন হচ্ছে চাঁদে অবতরণকারী মনুষ্যনির্মিত প্রথম বস্তু, যা ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদে অবতরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো-১১ মিশন চাঁদে মানুষের প্রথম সফল অবতরণ। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই মার্কিন মহাকাশচারী নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২-এর মধ্যে চাঁদের বুকে ছয়বার মানুষের অবতরণ ঘটে এবং অসংখ্যবার মনুষ্যবিহীন অবতরণ ঘটে। কিন্তু এরপরও ২০২৩ সালের ২৩শে আগস্ট বুধবার ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করা দেশটির মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩ কেন গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান-৩ নামিয়েছে চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুতে। বিশ্বে ভারতই প্রথমবারের মত এই অংশে চন্দ্রযান নামাতে পেরেছে। চাঁদের ওই অঞ্চলে রয়েছে বরফপানি অথবা জমাটবাঁধা বরফ। এতে স্থানটি পানির পাশাপাশি হতে পারে অক্সিজেন ও জ্বালানির উৎস, যা ভবিষ্যতে আরও চন্দ্রাভিযান অথবা স্থায়ীভাবে চাঁদে বসতি গড়তে সহায়ক হতে পারে। গত ১৪ জুলাই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশকেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণ করা হয়। চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডারের নাম ‘বিক্রম’, রোভারের নাম ‘প্রজ্ঞান’। ল্যান্ডারটি উচ্চতায় ২ মিটারের মতো, ওজন ১ হাজার ৭০০ কেজির বেশি। আকারে ছোট রোভারের ওজন ২৬ কেজি মাত্র। এই রোভারই চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাচ্ছে এখন।
চাঁদের পৃষ্ঠে চন্দ্রযান-৩ অভিযানের ফল কেবল ভারত নয়, বরং বিশ্বজুড়ে মহাকাশ গবেষণার সব সংস্থা উপকৃত হবে। যেমন বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান স্পারসো এই অভিযানের তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আগামীতে চাঁদে অভিযানের প্রচেষ্টা চালাতে পারবে। বাংলাদেশের তরুনদের বিজ্ঞান তথা মহাকাশ গবেষণা নিয়ে আগ্রহ বাড়াবে ভারতের চন্দ্রযান-৩। ভারতের সাফল্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, চন্দ্র মিশন একটি অত্যন্ত গর্বের বিষয় এবং সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জন্য অনুপ্রেরণা। তবে এই সফলতার পেছনে ব্যার্থতার গল্পও রয়েছে। ২০১৯ সালে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণের উদ্দেশ্যে চন্দ্রযান-২ পাঠিয়েছিল ভারত। কিন্তু অভিযানটি ব্যর্থ হয়। সেই ব্যার্থতা ইসরোর বিজ্ঞানীদের মনোবল আরও দৃঢ় করেছিল বলেই আজ তারা সার্থক।
চাঁদের এই অংশে অভিজান যে এত সহজ নয় তার উদাহরন আরেকটি ব্যর্থতার গল্প। ভারতের চন্দ্রযান ৩ যখন উৎক্ষেপন করা হয় তখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের জন্য লুনা-২৫ নামের মহাকাশযান পাঠিয়েছিল রাশিয়া। তবে রাশিয়ার মহাকাশযানটি চাঁদেই বিধ্বস্ত হয়। যার মধ্য দিয়ে ৪৭ বছরের মধ্যে রাশিয়ার প্রথম চন্দ্রাভিযান ব্যর্থ হয়। ভারতের মহাকাশযানটির সফল অবতরণ করায় সবার চোখ এখন বিজ্ঞানের দিকে। পরবর্তী ১৪ দিন ওই অঞ্চলটি সূর্যের আলোতে আলোকিত হওয়ার সময় চন্দ্রযান-৩ এর দিকে নজর রাখবেন বিজ্ঞানীরা।
ইসরো বলেছে, অঞ্চলটি আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলে ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’র অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই মিশনের এক চান্দ্রদিন বা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান একটি সময়সীমা রয়েছে। ভারতের চন্দ্রযান-৩ কে চাঁদে পাঠানোর এই মিশনে খরচ হয়েছে ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন রুপি বা সাড়ে ৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৮২০ কোটি ৮০ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। এর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চাঁদের বুকে সফলভাবে নভোযান অবতরণ করিয়েছে। এখন তাদের সঙ্গে চতুর্থ দেশ হিসেবে যোগ হল ভারতের নাম।
প্রায় ৫৪ জন মহিলা ইঞ্জিনিয়ার/বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা চন্দ্রযান-৩ মিশনে সরাসরি কাজ করেছেন।যাদের মধ্যে ড. এস. সোমনাথ, চেয়ারম্যান, ইসরো, ডাঃ এস. উন্নীকৃষ্ণন নায়ার, পরিচালক, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার, ড. পি. ভিরামুথুভেল, প্রজেক্ট ডিরেক্টর, চন্দ্রযান-৩, এম শঙ্করন, পরিচালক, ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার, এই মানুষগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এদিকে, চন্দ্রাভিযানকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) নতুন লক্ষ্য স্থির করেছে। তবে এ পর্যায়ে ভারত আর একা নয়। জাপানের সঙ্গে ভারত যৌথভাবে ‘চন্দ্রযান-৪’ অভিযান চালাবে। এ অভিযানের নাম লুপেক্স (লুনার পোলার এক্সপ্লোরেশন মিশন) দেওয়া হয়েছে।
এই মিশন সংকলনের কারণে ভারত অনেক সুবিধা পাবে। চন্দ্রযান-৩ উদীয়মান "চাঁদ অর্থনীতিতে" ভারত নতুন উদ্যোক্তা সুযোগ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং জন্য দরজা খুলে দিবে চাঁদের পৃষ্ঠে মূল্যবান পর্যবেক্ষণ অন্বেষণ। এই সাফল্যে ভারতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চন্দ্রযান-৩। তিনি বলেন, চন্দ্র অভিযান অত্যন্ত গর্বের এবং অনুপ্রেরণার বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে। ভবিষ্যতে এই সফল মিশন একটি হয়ে উঠবে শুধুমাত্র ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নয়, বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্যও অনুপ্রেরণামূলক গল্প। এই মিশন ভারত এখন আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে যার কারণে মহাকাশ এখন ভারতের জন্য আরও সহজলভ্য। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গবেষণায় অশগ্রহন করতে পারবে।
মহাকাশ গবেষনায় ভবিষ্যতে চন্দ্রযান-৩ মাইলফলক হবে।
মহাকাশ গবেষনায় ভবিষ্যতে চন্দ্রযান-৩ মাইলফলক হবে।
লেখক: ফাইজা রাফা , সিলেট