সিলাকান্থের খোঁজেল্যাটিমারের আবিষ্কার প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানি মহলে হইচই পড়ে গেল। একটা যখন পাওয়া গেছে তখন নিশ্চয় আরো আছে। সিলাকান্থ খুঁজে আনতে পারলে পুরষ্কারের ঘোষণাও কেউ কেউ দিয়ে বসল। তবে প্রায় চৌদ্দ বছর জুড়ে আর কোন সিলাকান্থ পাওয়া গেল না। অনেকটা হঠাৎ করেই ১৯৫২ সালে আবারো ভারত মহাসাগর থেকেই আরেকটি সিলাকান্থ ধরা পড়ে। এবার স্থান ছিল কমোরস দ্বীপপুঞ্জ। ল্যাটিমারের পুরনো বন্ধু অধ্যাপক স্মিথ সাথে সাথে উড়াল দিলেন কমোরসের দিকে। এরপর আরো কয়েকটি সিলাকান্থ কাছাকাছি সময়ে একই এলাকা থেকে পাওয়া গেল। পরে দেখা গেল যে স্থানীয় জেলেদের কাছে সিলাকান্থ খুব সাধারণ একটি মাছ। তারা নাকি বহু আগে থেকেই জালে সিলাকান্থ পেত। এই মাছ শুকিয়ে নুন দিয়ে তারা রান্না করত, আবার মাছের আঁশ ব্যবহার করত নানা কাজে। পরের ২৩ বছর ধরে মোটমাট ৮২ টি সিলাকান্থ পাওয়া যায়।
ততদিন অবধি কেবল ল্যাটিমেরিয়া সিলাকান্থই পাওয়া যাচ্ছিল। অবস্থার পরিবর্তন হল ১৯৯৭ সালে। সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ ইন্দোনেশিয়ার এক মাছের বাজারে আরেক প্রজাতির সিলাকান্থের খোঁজ মিলল। মৎস্য বিশারদ ডক্টর মার্ক আর্ডম্যান নবিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছিলেন ইন্দোনেশিয়ার মানাদো তুয়া (Manado Tua)দ্বীপে। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তাই ডক্টর আর্ডম্যান স্থানীয় মাছের বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারলেন না। সেখানে ঘুরতে ঘুরে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক দোকানে ঝুলিয়ে রাখা নিলাভ এক মাছের প্রতি। একি! এতো সিলাকান্থ মনে হচ্ছে! এই সিলাকান্থ ছিল ল্যাটিমারিয়ার থেকে ভিন্ন প্রজাতি মানাদো তুয়ার সাথে মিল রেখে নতুন এই প্রজাতির নামে যুক্ত হল
মেনাডোনেন্সিস (menadoensis )।
আজকের দিনে মোটামুটিভাবে ২০০-৬০০ টি ল্যাটিমারিয়া সিলাকান্থ সাগরে আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এরা মূলত ১০০-৫০০ মিটার গভীরতায় বাস করে। মূলত ভারত মহাসাগরে তাদের দেখা যায়, আরো নির্দিষ্ট করে বললে কমোরস দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী সাগর তাদের প্রধান আবাস।এছাড়া মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা আর তাঞ্জানিয়াতেও মাঝেসাঝে এদের দেখা মেলে।
আকার আকৃতি সিলাকান্থ সাধারণ
মাছের থেকে বেশ বড়, মোটামুটি ১৮০ সেন্টিমিটার, বা৬ ফুটের মত লম্বা। ওজনেও বেশ ভারিক্কি, ৯৫ কেজির মত হতে পারে। মেয়ে সিলাকান্থ সাধারণত ছেলেদের থেকে বড় আর ভারি হয়। তাদের পাখনা বা ফিন অনেকটা হাত পায়ের মত দেখতে। এদের শরীরে ফুসফুসের মত অঙ্গেরও দেখা মেলে, যদিও তা নিষ্ক্রিয়। সিলাকান্থ বেশ দীর্ঘজীবীও বটে, ৪০-৫০ বছর বয়স অবধি বেঁচে থাকে। সিলাকান্থ দলবেঁধে চলাফেরা করে, শারীরিক সংস্পর্শ এদের পছন্দ নয়। স্বভাবের দিক থেকে এরা নিশাচর। দিনের বেলা কাটিয়ে দেয় সাগরের বিভিন্ন অন্ধকার গুহা বা পাথরের ফাঁকে। রাত হলে বেরিয়ে পড়ে খাবার খুঁজতে।
মেয়ে সিলাকান্থের
গর্ভকাল প্রায় তের মাস। একবারে ডিম থেকে ৫-২৬ টি পর্যন্ত সিলাকান্থ তারা জন্ম দিতে পারে। সিলাকান্থ খুব ধীরে ধীরে সাঁতার কাটে। মূলত সাগরের পানির প্রবাহ কাজে লাগিয়ে তারা সামনে পেছনে যায়। শিকারের ব্যাপারে তারা বেশ অলস। নিজে থেকে শিকারের কাছে যায়না, বরং খাপ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে কখন শিকারই তাদের কাছে আসবে। এজন্য এদেরকে বলা হয় ড্রিফট ফিডার। শিকার নাগালে আসা মাত্রই অনেকটা স্প্রিঙ্গের মত লাফ দিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের খাবার প্রধানত ছোট ছোট মাছ। সিলাকান্থের চোয়ালে একটি বিশেষ ধরণের জয়েন্ট আছে, যা আর কোন জীবিত প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়না। এর দ্বারা তার অনেক বড় হাঁ করে শিকার ধরতে পারে। তাদের নীলাভ আশও বিলুপ্ত হওয়া অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর থেকে আলাদা। তারা শরীরের একটি অঙ্গ থেকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম, যা তাদের দিক নির্দেশনা আর শিকারের কাজে লাগে।