কানাডা কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে?
আন্তর্জাতিক
কানাডা কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে?
উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহতম দেশ। প্রায় ৯.৯৮ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির ভূখণ্ডেই আছে পৃথিবীর মট স্থলসীমার ৬.১ শতাংশ। রাশিয়ার পরে এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ হলেও, কানাডার জনসংখ্যা বেশ কম, মাত্র ৩৮ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৮০ লক্ষ। প্রতিবছর কানাডা লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে মাত্র ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ অভিবাসীকে তাদের দেশে আসার সুযোগ দেয়। এককভাবে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে আছে কানাডা। একটি দীর্ঘ সময় ধরে উদার আর মুক্ত সমাজের চরিত্র কানাডা পৃথিবীর সামনে নির্মাণ করেছে, নির্মাণ করেছে কাঙ্ক্ষিত এক সমাজের চিত্র।

অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে কানাডা; Image Source: CIC News.
অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে কানাডা; Image Source: CIC News.
অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে কানাডা
অনেকদিন ধরেই অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে আছে কানাডা, সবচেয়ে বেশি অভিবাসীকে গ্রহণও করে কানাডা। এই দশকের শুরু থেকেই কানাডাতে প্রতিবছর অভিবাসীর সংখ্যা দুই লাখের উপরে ছিলো। সময়ের সাথে সাথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের চাপ বেড়েছে, কানাডা দক্ষতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় নিচ্ছে আগের চেয়ে বেশি অভিবাসী। ২০১৭ সালেই প্রতিবছর নতুন অভিবাসীর সংখ্যা তিন লাখ ছুঁয়ে ফেলে, ২০২২ সালে এই সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি হওয়ার কথা।
বিভিন্ন কারণেই অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে কানাডা, রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি

মানুষ স্বভাবতই মুক্ত নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, মুক্ত মানুষ হিসেবে মানুষ তার জীবনকে সাঁজাতে চায়। কিন্তু, প্রতিনিয়ত মানুষকে বিভিন্ন সীমারেখায় বাঁধে সমাজ আর রাষ্ট্র, বেঁধে দেয় স্বাধীনতার সীমা। এর সাথে উপরি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয় কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বিভিন্ন বিধিনিষেধ আর বাঁধা-বিপত্তি, হরণ করে মানুষের মৌলিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা। কানাডার ক্ষেত্রে এই চিত্রটি বেশ বিপরীত। ফ্রান্সের উপনিবেশ শাসন থেকে ব্রিটিশদের উপনিবেশ শাসনে যায় কানাডা, এখনো যুক্তরাজ্যের রাণীকেই আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কানাডা, রাণীর প্রতিনিধি হিসেবে কানাডাতে থাকেন একজন গভর্নর জেনারেল। এর বাইরে, বাকি সকল রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদের জন্য কানাডাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্বাচনী কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী কানাডাতে। আইনের শাসন রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েচেহ সংঘাত সমাধানের জন্য কার্যকর সংলাপের উপায়। ক্ষমতার পালাবদল হয় অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে, কখনো নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে না, চেষ্টা করে না রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্মূল করে দিতে। বরং, কানাডাতে অত্যন্ত কার্যকর নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ।
এই মুক্ত পরিবেশই কানাডার ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করে তোলে সবার আগে।
নাগরিকবান্ধব সমাজকাঠামো রয়েছে কানাডাতে; Image Source: Pixels.
নাগরিকবান্ধব সমাজকাঠামো রয়েছে কানাডাতে; Image Source: Pixels.
শিক্ষাব্যবস্থা
কানাডাতে যেসব মানুষ অভিবাসী হতে চায়, তাদের বড় একটা অংশ শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীরা সাধারণত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কানাডাতে আসেন, কানাডাতে স্থায়ী হওয়ার চিন্তাভাবনা করেন পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে। নিজের প্রজন্মের জন্য উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সামগ্রিক শিক্ষাকাঠামো, সব জায়গাতেই কানাডা ইতোমধ্যেই বিশ্বসেরা একটি দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। কানাডাতে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ভ্যানকুবার, ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুর মতো বিখ্যাত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান, আছে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পৃথিবীব্যাপী পরিচিত, পরিচিত তাদের সামগ্রিক অর্জন আর গবেষণা কাঠামোর জন্য। অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রাথমিক আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাকাঠামোতেও কানাডার উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলা হয়েছে সার্বজনীন হিসেবে। প্রাথমিক আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা বিনামূল্যে দেয় কানাডা, পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষাতেও থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা আর রাষ্ট্রীয় সহায়তা। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে কানাডা ১৮৯ টি দেশের মধ্যে রয়েছে ১৬ তম স্থানে।
ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো; Image Source: Times Higher Education.
ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো; Image Source: Times Higher Education.
স্বাস্থ্যসেবা
মানুষ যেসব মৌলিক অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, চিকিৎসার সুবিধা তার মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর অনেক দেশেই চিকিৎসা সুবিধা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে, অনেক দেশেই আবার চিকিৎসা সুবিধা সরকারি আর বেসরকারি পার্টনারশিপে পরিচালিত হয়। তবে, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই বর্তমানে চিকিৎসাকে সার্বজনীন করার চেষ্টা করছে, যুক্তরাজ্যে যেই কাজ করে এনএইচএস, যুক্তরাষ্ট্রে একই ধরনের কাঠামো তৈরির পক্ষে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছেন বার্নি স্যান্ডার্স। কানাডাতে একই ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং নাগরিকেরা এই স্বাস্থ্যসেবা পান বিনামূল্যে, নিয়মিত কর পরিশোধের বিনিময়ে।
জীবনমান
কানাডা সামাজিক কাঠামো পৃথিবীর সবচেয়ে স্থিতিশীল সামাজিক কাঠামোগুলোর একটি, কানাডার বাজার ব্যবস্থাপনাও পৃথিবীর অন্যতম সেরা। কানাডাতে আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটে না, বাজার রেগুলেশন ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর। ফলে, কানাডাতে এভারেজ আয় করেও বেশ ভালো জীবনযাপন করা সম্ভব, সম্ভব দৈনন্দিক জীবনের চাহিদা নিজের আয় থেকেই পূরণ করা। কানাডাতে মাথাপিছু আয় বেশ বেশি, বেকারত্বের হার কম, রয়েছে শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা বলয়। পাশাপাশি, কানাডার ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাও বেশ বন্ধুসুলভ, যেটি আসলে কানাডার সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থারই চিত্র তুলে ধরে। এসব কারণেও কানাডা অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে।
অভিবাসীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো রয়েছে কানাডাতে; Image Source: Immigration Blog.
অভিবাসীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো রয়েছে কানাডাতে; Image Source: Immigration Blog.
অভিবাসীবান্ধব সমাজকাঠামো
কানাডার মূল সমাজের বড় একটা অংশ এসেছে ইউরোপ থেকে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক অভিবাসন হচ্ছে এশিয়া থেকে। এই অভিবাসীরাই বর্তমানে কানাডার সমাজের মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে, নতুন অভিবাসীরা কানাডাতে এসে রক্ষণশীল কোন কাঠামোর মুখোমুখি হয় না, বরং মোটাদাগে কানাডার সমাজ অভিবাসীদের বরণ করে নেয়, সহযোগিতা করে মানিয়ে নিতে, কানাডার সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকেই কানাডাতে অভিবাসীরা আসে, এই অভিবাসীরাই কানাডার সমাজকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময়, করে তুলেছে সামগ্রিকভাবে আকাঙ্ক্ষিত এক সমাজ। আপনিও কি অভিবাসী হতে চান? কানাডা হতে পারে আপনার প্রথম আর সেরা পছন্দ।  
আন্তর্জাতিকপ্রবাসকানাডা
আরো পড়ুন