অপারেশন সার্চলাইট: জানা-অজানার এক ইতিহাস
জাতীয়
অপারেশন সার্চলাইট: জানা-অজানার এক ইতিহাস
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসে ২৫শে মার্চ ছিল একটি নির্মম গণহত্যার দিন। "অপারেশন সার্চ লাইট" নামে পরিচালিত ওই নির্মম হত্যাযজ্ঞ বা অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করে ও সামরিক অভিযান চালিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬০ আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন ঢাকায়। কিন্তু মার্চের ১ তারিখে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বেতার বার্তায় সুর পরিবর্তন করে তিনি অধিবেশন স্থগিত করেন। ফলে সারা বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২ ও ৩ তারিখে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে সংঘর্ষে অনেকে আহত হন।
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
এদিকে আইয়ুব খানের আদেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলায় প্রচুর পরিমাণে সেনা আসা শুরু করে। তিনি টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অধিকারের লড়াইয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। ৭ মার্চের ঘোষণার পর কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুরো দেশ চলতে থাকে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঠিকঠাক যাতে চলে সেজন্য বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ ৩৫টি বিধি জারি করেন।এদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে নীরবে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গণহত্যার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মার্চের ২৪ তারিখে ইয়াহিয়া খান টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে নির্দেশ প্রদান করেন অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার জন্য। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে পাকিস্তান চলে যান অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার আগে।
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
২৪ মার্চ রাও ফরমান আলী লে. কর্নেল এ জেড খানকে ২৫ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে নির্দেশ দেন। সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বই 'উইটনেস টু সারেন্ডার' এ লিখেছেন, শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনার কী পরিণাম হয়, তা নিয়ে ২৫শে মার্চ দুপুরে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন নিজের দপ্তরে বসে যখন ভাবছিলেন, তখন তাকে ফোন করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। সরাসরি বলেন, "খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।" খাদিম নিজের কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে ওই আদেশ পালনের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, "ক্র্যাকডাউনের সময় ঠিক করা হয়েছিল ২৬শে মার্চ রাত একটায়। আশা করা হচ্ছিল যে ততক্ষণে ইয়াহিয়া খান করাচিতে পৌঁছে যাবেন।"  
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বেশ আগেই, একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ম্যাসাকার বইতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো। বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে (কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস)।’ গবেষকরা বলছেন, শেখ মুজিবুর রহমান কতটা শর্ত দিবেন আর দিবেন না, তার ওপর নির্ভর করেই বাঙালিদের ভয় দেখানোর মধ্য দিয়ে শেষ করার পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি লারকানা হাউজে। তবে সেটি ভুট্টো করেছিলেন কৌশলে পাখি শিকারের নাম করে বৈঠক ডাকার মধ্য দিয়ে। এরপর হাসতে-হাসতেই ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ফেলেন তারা।  
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
লারকানা ষড়যন্ত্র বিষয়ে কতটা জানা গেছে প্রশ্নে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘বৈঠকটা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে। সেখানে যারা যারা ছিলেন বলে নাম আসে তারা হলেন ইয়াহিয়া, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, প্রধান স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসজিএমএ পীরজাদা। অন্য আরও অনেকের নাম বের হয়নি। সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, সেখানেই বাংলাদেশে গণহত্যার প্রথম পরিকল্পনা করা হয়।’ পঁচিশে মার্চ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার টিক্কা খানের কাছে অনুমোদন চেয়েছিলেন ক্র্যাকডাউনের সময়টা এগিয়ে আনার। সালিক লিখছেন, "জেনারেল টিক্কা আদেশ দিয়েছিলেন যতটা সম্ভব দেরি করতে। এরপর রাত সাড়ে এগারোটায় পুরো শহরের ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করেছিল। শুরু হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট।" 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা ড. কামাল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, "পঁচিশ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমরা রিপোর্ট পাওয়া শুরু করলাম যে, সব ট্যাংক ক্যান্টনমেন্টে লাইন আপ করা হচ্ছে, আক্রমণ করার প্রস্তুতি সেখানে চলছে। আমরা এটা বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট করলাম, বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, হ্যাঁ এখন তো মনে হয় তারা অ্যাকশনে যাবে। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশে রেকি করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এরপর তাঁর বাড়িতে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করে প্রস্তুতি শুরু করা হয় পাশবিক তাণ্ডব চালানোর। পাকিস্তানী সেনারা ১১টা ৩০ মিনিটে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ফার্মগেটে মিছিলরত বাঙালিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা করে। পাকিস্তানী প্রশাসন কোনো পাল্টা আক্রমণের যাতে শিকার হতে না হয়, সেজন্য মার্চ মাসের শুরু থেকেই বাঙালি সেনা ও পুলিশদের নিরস্ত্র করা শুরু করে। অনেক বাঙালি সেনাকে ছুটিতে পাঠানো হয় এবং পাকিস্তানে বদলি করা হয়।
আক্রমণের প্রথম হিটলিস্টে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এরা কারফিউ জারি হওয়ার সাথে সাথে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং হলগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল,এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু। ৭ জন শিক্ষকসহ প্রায় ২০০ জন ছাত্র-কর্মচারীকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলিগ নেতা শাহ চিশতী হেলালুর রহমানকে হলের ২১৫ নম্বর রুমে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরে হানাদার বাহিনী জগন্নাথ হল, শহিদুল্লাহ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, রোকেয়া হলে হামলা চালায়। পুরো ঢাকা শহরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাণ্ডবলীলা চালায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুরো ঢাকাকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করে। তারা ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়। এতে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি শহীদ হয়। রবার্ট পেইনের মতে, অভিযানের প্রথম রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামে। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞের সৃূচনা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের জন্য পরবর্তীতে বর্হিবিশ্বের কাছে নিন্দা শুনতে হয়েছে দায়ী শাসকদের।  
জাতীয়বিশেষ প্রতিবেদন
আরো পড়ুন