বিশেষ প্রতিবেদন
ঐতিহাসিক ‘হেরা গুহা’ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
জাবালে নূর কিংবা গারে হেরা তথা হেরা গুহা সম্পর্কে জানতে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এই গুহায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সেখানে ওঠা একদমই সহজ ছিল না তখন। ছিল না উপরে ওঠার কোনো সহজ পথ। ৬১০ সালের এক রাতের ঘটনা। হেরা গুহায় আল্লাহর এবাদাতে মগ্ন রাসূল (সাঃ)। সে সময় হটাত করেই সেখানে হাজির হন আল্লাহর দূত জিবরাইল (আঃ)। একটি আয়াত দেখিয়ে বলা হয়, পড়ো। রাসূল (সাঃ) অপারগতা প্রকাশ করেন।

রাসূল (সাঃ) এর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। তাঁর পরিচ্ছন্ন অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে স্বজাতীয়দের সাথে তাঁর মানসিক ও চিন্তার দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে ততদিনে। এ অবস্থায় রাসূল (সাঃ) নিঃসঙ্গপ্রিয় হয়ে উঠলেন। নির্জনতায় দিন কাটাতে তিনি ছাতু এবং পানি নিয়ে মক্কা থেকে মাইল দুয়েক দূরের হেরা পাহাড়ের গুহায় গিয়ে সময় কাটাতে শুরু করলেন। হেরা গুহা মসজিদুল হারামের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই গুহাটি যে পাহাড়ে অবস্থিত সেটির উচ্চতা প্রায় ৬৪২ মিটার। ছোট আকারের গুহাটি চার গজ দৈর্ঘ্য ও পৌনে দুই গজ প্রস্থ নিয়ে গঠিত। গুহাটির নিচের দিক অতটা গভীর নয়। ছোট একটি পথের পাশে ওপরের প্রান্তরের সংযোগস্থলে এ গুহার অবস্থান।

রাসূলের সময়কালে এই গুহায় পৌঁছানো একদমই সহজ ছিল না। ছিল না উপরে ওঠার কোনো সহজ পথও। হেরা গুহাটি পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় না হলেও সেখানে যেতে হলে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠতে হয়। সেখানে ওঠা ছাড়া হেরা গুহায় যাওয়ার কোনো বিকল্প পথ নেই। এই পথে পেরোতে হয় প্রায় ১২০০ ধাপ। বর্তমানে যেখানে ওঠতে শক্তিশালী ও সামর্থবান মানুষদের প্রায় দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠতে বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিতে হয়। আশেপাশে কোনো পানি বা গাছপালা না থাকায় বন্ধুর এই পথ পাড়ি দেয়া আরো বেশি কষ্টকর।

হেরা গুহা যে পাহাড়টিতে অবস্থিত সেটি বর্তমানে জাবালে নূর নামেই অধিক পরিচিত। রাসূল (সাঃ) এই গুহায় যাতায়াত শুরুর পর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাঃ)ও সঙ্গে যেতেন, রাসূলের নিকটবর্তী কোন জায়গায় অবস্থান করতেন। রাসূল (সাঃ) পুরো রমযান মাস এই গুহাতেই কাটাতেন। পথচারী মিসকিনদের খাবার খাওয়াতেন। বাকি সময়টা আল্লাহর এবাদাতে কাটাতেন। গভীরভাবে চিন্তা করতেন জগতের দৃশ্যমান এবং এর পেছনে কার্যকর কুদরতের কারিশমা সম্পর্কে। স্বজাতির লোকদের মূর্তিপূজা এবং নোংরা জীবন যাপন দেখে তিনি শান্তি পেতেন না। কিন্তু তাঁর সামনে সুস্পষ্ট কোনো পথ, পদ্ধতি কিংবা প্রচলিত অবস্থার বিপরীত কোনো কর্মসূচীও ছিল না, যার ওপর জীবন কাটিয়ে তিনি মানসিক শান্তি ও স্বস্তি পেতে পারেন।

রাসূলের বয়স চল্লিশ পার হওয়ার পর তাঁর জীবনের দিগন্তে নবুওয়াতের নিদর্শন চমকাতে লাগলো। এই নিদর্শন প্রকাশ পাচ্ছিলো স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যখনই কোনো স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদিকের মত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল ছয়টি মাস, যা ছিল নবুওয়াতের সময় সীমার ৪৬তম অংশ। নবুওয়াতের সময়সীমা ছিল ২৩ বছর। তিনি হেরাগুহায় নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন৷ এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে হেরা গুহায় নির্জনাবাসের তৃতীয় বছরে আল্লাহ জগতবাসীকে তাঁর করুণাধারায় সিঞ্চিত করতে চাইলেন, নবুওয়াত দান করলেন রাসুল (সাঃ) কে।

ইতিহাসের যুক্তি-প্রমাণ এবং কোরআনসহ বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করে পাওয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায় যে, প্রথম ওহী এসেছিল রমযান মাসের ২১ তারিখ রাতে। দিনটি ছিল সোমবার। খ্রিস্টীয় হিসাব অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগস্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী, সে সময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর ছয় মাস বার দিন এবং সৌর হিসাব অনুযায়ী ছিল ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।
প্রথম ওহী নিয়ে হেরা গুহায় এসেছিলেন হযরত জিবরাইল (আঃ)। হযরত আয়েশা (রাঃ) এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) হেরা গুহায় এবাদাত বন্দেগীতে মগ্ন থাকতেন এবং এ সময় একাধারে অনেকদিন তিনি ঘরে ফিরতেন না। পানাহার সামগ্রী শেষ হলেই শুধু তিনি ঘরে গিয়ে আবার পানাহার সামগ্রী নিয়ে গুহায় ফিরতেন। এমনই এক সময়ে জিবরাইল (আঃ) রাসূলের কাছে আসেন, তাঁকে বলেন 'পড়ো'।

রাসূল (সাঃ) বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। জিবরাইল (আঃ) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন। এরপর আবার যখন রাসূলকে পড়তে বলা হলো তখনও তিনি পড়তে না পারার অপরাগতার কথা স্বীকার করেন। এরপর আরো দুইবার একইভাবে ফেরেশতা তাঁকে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন। তারপর বললেন, 'পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।' নাযিল হয় পবিত্র কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) হেরা গুহা থেকে ঘরে ফিরে আসেন। নবীজি সে সময় যথেষ্ট ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বিবি খাদিজা রাসূলকে অভয় দেন, তাঁকে নিয়ে যান আপন চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযয়ার কাছে। ওয়ারাকাই প্রথম রাসূলকে নিশ্চিত করে বলেন যে ওহী নিয়ে আসা দূতই আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ)।
এর কিছুদিন পর ওয়ারাকার মৃত্যু হলে হটাতই ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যায়। ইবনে হিশামের এক বর্ণনায় এসেছে, ওহী নাযিল বন্ধ হওয়ার সময়েও রাসূল (সাঃ) হেরা গুহায় আরো কিছুকাল অবস্থান করে নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করেন। পরে মক্কায় ফেরেন তিনি। ওহী স্থগিত থাকার সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে, তবে কয়েকদিন স্থগিত ছিল বলে ইবনে আব্বাসের এক বর্ণনায় এসেছে। এরপর হযরত জিবরাইল (আঃ) পুনরায় ওহী নিয়ে হাজির হন রাসুলের কাছে। হেরা পাহাড় ঘিরে নবীজির অনেক স্মৃতি রয়েছে। একবার নবীজি কয়েকজন সঙ্গীসহ এ পাহাড়ে আরোহণ করেন। তখন পাহাড়টি কাঁপতে শুরু করে।
শান্ত হও হে হেরা, তোমার ওপর একজন নবী, একজন সিদ্দিক ও একজন শহীদ অবস্থান করছেন
হেরা গুহার মুখ কাবা ঘরের দিকে মুখ করা। হেরা গুহায় পৌছানো বেশ কষ্ট সাধ্য হলেও প্রিয় নবীর স্মৃতিধন্য হওয়ায় হজযাত্রী-পর্যটকদের কাছে এটি একটি প্রিয় স্থান।।প্রতি বছর হজের মৌসুমে দিনে গড়ে প্রায় হাজার পাঁচেক মুসল্লীর আগমন ঘটে হেরা গুহায়। বিগত বছরগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজের অভাবে হেরা গুহার ব্যাপক সৌন্দর্যহানি হয়। দর্শনার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত চলাচল ও ফেলে আসা বিভিন্ন জিনিসের কারণে মূল অবয়বও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে। দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কারের পরিকল্পনা থাকলেও স্বাভাবিক সময়ে হেরা গুহায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজিদের ভীড়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এবার করোনার লকডাউনের সময় সেই সংস্কার করা হলো।

সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে সিঁড়ি সম্প্রসারণ ও রাস্তা বড় করা হয়েছে। গুহার আশেপাশে থাকা অবাঞ্চিত পাথর সরিয়ে ফেলাসহ, বিভিন্ন পাথরের গায়ের লেখা মুছে ফেলা হয়েছে। গুহার পাশে হাজিদের ফেলে আসা নানা জিনিসপত্র, পুঁতে রাখা তাবিজ-কবজ ও অস্থায়ীভাবে নির্মিত অবকাঠামোগুলো অপসারণ করা হয়েছে। এখন আর হেরা গুহায় কোনো লেখা বা অঙ্কন নেই। এতদিন অনেকে বিভিন্ন মান্নত পূরণের জন্য পাথরে কালি দিয়ে বিভিন্ন কিছু লিখে আসতো।