জাতীয়
অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর: যেভাবে ঝড়ের নামকরণ
ঘূর্ণিঝড়' বাংলাদেশের মানুষের কাছে বহু বছর ধরেই এক অতি পরিচিত শব্দ। দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশটি প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল থাবার শিকার হয়ে থাকে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই উপকূলীয় মানুষগুলো জীবন হারায়, হারায় বহু কষ্টে গড়ে তোলা ভিটেমাটি, অসহায় হয়ে দেখে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসলের জমির পানিতে তলিয়ে যাওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা 'ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড' ১৬৯৯ সাল থেকে মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে বিশ্বের ৩৫টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা করেছে। এই তালিকার ২৬টি ঘূর্ণিঝড়েরই উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর, যার ১৯টিই বড় ধরনের ক্ষতি ঘটিয়েছে বাংলাদেশে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর উপসাগরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি একটি ফানেল হিসেবে কাজ করে এবং যখনই একটি ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে আসে, তখন প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটির অগভীর তল এই ঝড়কে আরও তীব্র করে তোলে। সাগরের ফুঁসে ওঠা পানি এই ফানেল বরাবর ছুটতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পেছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ- সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা। বঙ্গোপসাগরে এই দুটিই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আদর্শ মানদণ্ডে বিরাজ করে। চারদিকের অলস বাতাস যেমন পৃষ্ঠের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে প্রায় ২৮ ডিগ্রিতে বজায় রাখে, অবিরাম বৃষ্টিপাত তেমনই আর্দ্রতাকেও রাখে উচ্চ মানে।বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি বঙ্গোপসাগর জুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের গঠন ও তীব্রতায় সহায়ক করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নজিরবিহীন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ঝড় দ্রুততর তীব্রতার পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করে।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের চর্চা কয়েক’শো বছর আগেই শুরু হয়। নামকরণের কারণ হিসেবে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, নামকরণের ফলে ঝড়গুলো দ্রুত শনাক্ত করে সে অনুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়। তাছাড়া, সবরকম ব্যবস্থাতেই সংখ্যা অথবা প্রযুক্তিগত শর্তের চেয়ে নাম মনে রাখাটাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম সময়ে দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ও স্বতন্ত্র প্রদত্ত নামগুলোর ব্যবহার পুরোনো জটিল অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ শনাক্তকরণ পদ্ধতির তুলনায় অনেকাংশেই সুবিধা দেয়। এই সুবিধাগুলো বিশেষত কয়েক শতাধিক বিস্তৃত স্টেশন, উপকূলীয় ঘাঁটি এবং সমুদ্রের জাহাজগুলোর মধ্যে বিশদ ঝড়ের তথ্য বিনিময় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, ঝড়ের নাম দেওয়া থাকলে কাছাকাছি সময়ে সৃষ্টি হওয়া একের অধিক ঝড়ের তথ্য সং

ইতিহাস বলছে, শুরুর দিকে ঝড়ের নাম রাখায় কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হতো না। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঝড়ের জন্য নারীসূচক নাম ব্যবহারের অনুশীলন শুরু হয়েছিল। ইভান রে টানেহিল তার লেখা বই দ্য হারিকেনে অস্ট্রেলিয়ান আবহাওয়াবিদ ক্লিমেন্ট রেগের নাম উল্লেখ করেন, যিনি ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ব্যক্তিবিশেষের নাম দেয়া শুরু করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য তিনি গ্রিক বর্ণমালা, গ্রিক এবং রোমান পৌরাণিক তত্ত্ব ও নারীসূচক নাম ব্যবহার করতেন। ১৯৭৭ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা হারিকেন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭৮ সালের মে মাসে। বৈঠকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের দায়িত্ব পায় এই কমিটি।

১৯৭৮ সাল থেকে এই কমিটির সিদ্ধান্তে পূর্ব-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঝড়ের তালিকায় মতো নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের নাম ব্যবহার শুরু হয়। পরের বছর মেক্সিকো এবং আটলান্টিক উপসাগরীয় অঞ্চলেও পুরুষদের নাম ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে বার্ষিক ও দ্বিবার্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বিশ্বব্যাপী পাঁচটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আঞ্চলিক সংস্থা বা প্যানেল কর্তৃক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব জুড়ে ঘূর্ণিঝড় নামকরণে দশটি আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত রয়েছে:
ক্যারিবিয়ান সাগর, মেক্সিকো উপসাগর এবং উত্তর আটলান্টিক
২. পূর্ব-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর
৩. মধ্য-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর
৪. পশ্চিম-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন
৫. অস্ট্রেলিয়ান ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত
৬. আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া কেন্দ্র নাদি'র আওতাভুক্ত, ওয়েলিংটন
৭. মরেসবি বন্দর ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত, পাপুয়া নিউগিনি
৮. জাকার্তার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত
৯. উত্তর ভারত মহাসাগরের আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর
১০. দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর
২. পূর্ব-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর
৩. মধ্য-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর
৪. পশ্চিম-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন
৫. অস্ট্রেলিয়ান ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত
৬. আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া কেন্দ্র নাদি'র আওতাভুক্ত, ওয়েলিংটন
৭. মরেসবি বন্দর ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত, পাপুয়া নিউগিনি
৮. জাকার্তার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত
৯. উত্তর ভারত মহাসাগরের আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর
১০. দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর

ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলোয় সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগর থেকে। এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের প্রচলন শুরু হয় ২০০৪ সালে। ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি আঞ্চলিক সংস্থা বা প্যানেলের একটি হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা- জাতিসংঘ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন। ২০০০ সালে ওমানে এই প্যানেলের ২৭তম বৈঠকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৪ সালে আটটি সদস্য দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড) প্যানেলের মাধ্যমে নামকরণ শুরু হয়। সে সময় আটটি দেশ থেকে আটটি করে মোট ৬৪টি নামের তালিকা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও পাঁচটি দেশ এই প্যানেলের সদস্য হয়। এগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ইয়েমেন। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে প্রথম নামকরণকৃত ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। সিডর নামে আঘাত হানা প্রলয়কারী সেই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা।

নামকরণের বিষয়টি সমন্বয় করে ভারতের দিল্লির 'রিজিওনাল স্পেশালাইজড মেটেরিওলজিক্যাল সেন্টার' (আরএসএমসি)। আরএসএমসি তার সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়ে থাকে। তালিকা পেলে দীর্ঘ সময় যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার কাছে পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্য। এই প্যানেলের নামকরণে বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করা হয়। প্যানেল সদস্যদের তালিকা হয় ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে। এজন্য বাংলাদেশ এই তালিকায় প্রথমে আছে। প্রত্যেক দেশ থেকে নামের তালিকা থেকে একটি করে নাম নিয়ে কলাম তৈরি করা হয়। নামকরণ করা শুরু হয় এই কলামে থাকা ওপরের নামটি দিয়ে। এভাবে একটি কলাম শেষ হলে পরের কলাম থেকে নামকরণ করা হয়। একটি নাম শুধুমাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়। দক্ষিণ চীন সমুদ্র থেকে যদি কোনো গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হিসাবে বঙ্গোপসাগরে আসে, তবে আগে থেকে নাম দেয়া থাকলে নতুন করে আর নামকরণ করা হয় না।
২০০৪ সালে ৬৪টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা করার পর এখন পর্যন্ত আর তালিকা করার প্রয়োজন পড়েনি। তালিকার সর্বশেষে থাকা থাইল্যান্ডের দেওয়া নাম 'আম্ফান' ২০২০ সালের মে মাসের শুরুতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে মায়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার–চট্টগ্রাম উপকূলের দিকে আঘাত হানতে পারে। তালিকায় নাম শেষ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের এপ্রিলে সদস্য ১৩টি দেশ থেকে ১৩টি করে মোট ১৬৯টি নতুন নামের তালিকা করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম এই তালিকা থেকেই দেয়া হচ্ছে।