নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের এতো আগ্রহ?
আন্তর্জাতিক
নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের এতো আগ্রহ?
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুশ অজানাকে আজানার আর অদেখাকে দেখার জন্য জ্ঞাত সীমানার একমাত্র থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে, যানবাহন ব্যবস্থার উন্নতির পরে মানুষ ছুটে বেড়িয়েছে অজ্ঞাত শহর আর সীমানার খুঁজেও। আবার, শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল বাড়িকে কেন্দ্র করে, মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো কৃষিকেন্দ্রিক। সেই সময়ে মানুষের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র অংশ এক মানবসভ্যতা থেকে অন্য মানবসভ্যতায় যাতায়াত করতো বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেও। সেই সময়ে উৎপাদন ছিল সীমিত, উৎপাদন সক্ষমতাও ছিল সীমিত। সীমিত উৎপাদন সক্ষমতার সাথে ছিল যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা আর দূর্গমতা।

বৈচিত্র্যময় নিউজিল্যান্ডের সংস্কৃতি; Image Source: Big 7 Travel.
বৈচিত্র্যময় নিউজিল্যান্ডের সংস্কৃতি; Image Source: Big 7 Travel.
বাণিজ্য হোক আর অচেনাকে চেনার কৃষ্ণচূড়াই হোক, মানুষ প্রতিনিয়ত একস্থান থেকে অন্যস্থানে বদলি হয়েছে, জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে পরিবর্তন করেছে বাসস্থান। যেকোন কারণেই হোক, প্রতিনিয়ত অনুত জায়গায় যাওয়া আর বদলি হওয়া মানুষের স্বভাবের অংশ হয়ে গেছে, মানুষ প্রতিনিয়ত উন্নত জীবন আর আনন্দলোকের সন্ধানে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যায়।

অভিবাসন প্রত্যাশীদের বর্তমান ট্রেন্ড

আধুনিক সময়ে এসে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার। পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে খুব সহজেই অন্যপ্রান্তের খোঁজ নেওয়া যায়, অভিবাসনের পূর্বের তুলনামূলক আলোচনা তুলে আনা যায় সম্ভাব্য দেশগুলোর মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে, দক্ষ আর শিক্ষিত অভিবাসন প্রত্যাশীরা বেঁছে নিচ্ছে প্রথম বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ, যার মধ্যে রয়েছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড, যার জনসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ বা তার অল্প বেশি। দেশটির রাজধানী ওয়েলিংটনে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি থাকা নিউজিল্যান্ড একটি বহু-জাতিগত ও বহু-সাংস্কৃতিক সম্মিলনের দেশ। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকেই মানুষ আসে নিউজিল্যান্ডে, সাম্প্রতিক সময়ে নিউজিল্যান্ডে মানুষ আসছে প্রথম বিশ্ব থেকেও।
নিউজিল্যান্ড ; Image Source: New Zealand Now.
নিউজিল্যান্ড ; Image Source: New Zealand Now.
কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দ নিউজিল্যান্ড?
একদেশ থেকে অন্যদেশে গিয়ে স্থায়ী হওয়া বর্তমান সময়ে অত্যন্ত নিয়মিত একটি ঘটনা। অভিবাসন প্রত্যাশীরা সাধারণত নিজের যোগ্যতা আর আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে দেশ নির্বাচন করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষ আর যোগ্যতা সম্পন্ন অভিবাসীদের পছন্দের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর একটি নিউজিল্যান্ড। অনেকগুলো কারণেই নিউজিল্যান্ড অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষদের পছন্দের শীর্ষে উঠে এসেছে।
নৈসর্গিক সৌন্দর্য
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলো একটি নিউজিল্যান্ড। এর নিরন্তর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেকোন অভিবাসন প্রত্যাশীকেই বিমোহিত করবে, বিমোহিত করবে তরুণ, যুবা আর বৃদ্ধদেরও। নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে ভূমি বৈচিত্র্য, আবার রয়েছে জলবায়ুর তারতম্য। দ্বীপরাষ্ট্রের উত্তর অংশ তুলনামূলকভাবে উষ্ণ, তুলনামূলকভাবে শীতল দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণ অংশ। নিউজিল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দারাও প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করে নিউজিল্যান্ডকে, আবিষ্কার করে নিউজিল্যান্ডের নতুন রূপ। নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া, রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতাকেন্দ্রিক অবকাঠামো। নিউজিল্যান্ডের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দোলা দেয় অভিবাসন প্রত্যাশীদের মনেও। অভিবাসন প্রত্যাশীরা যখন দেশ, কাল আর স্বজনদের পেছনে ফেলে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নতুন কোন কাঠগোলাপের পৃথিবীতে, তখন নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশ নির্ধারণে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জনসংখ্যা কম হওয়ায় নিউজিল্যান্ডে জমির দামও তুলনামূলকভাবে কম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নিউজিল্যান্ড; Image Source: Road Scholar
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নিউজিল্যান্ড; Image Source: Road Scholar
জীবনমান আর জীবনাচার
নিউজিল্যান্ডে বর্তমান সময়ে যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকেও অভিবাসীরা এসে স্থায়ী হচ্ছেন, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের জীবনমান আর জীবনাচার। নিউজিল্যান্ডে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে খুব ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হয়, ইতিবাচকভাবেই সমাজে গ্রহণ করা হয় অভিবাসন প্রত্যাশীদের। নিউজিল্যান্ডে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো রয়েছে, একেবারে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ঔষধপত্র, সবই হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়, চিকিৎসা সুবিধা সকলের জন্য সমান। এর পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে উদ্ভাবনী কাজকর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে, জীবনমানের ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অংশটি রয়েছে, সেটি হচ্ছে কর্মজীবন আর অবসর জীবনের মধ্যে সামঞ্জস্য। প্রথম বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সাধারণত কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি, অবসর উৎযাপনের সুযোগ থাকে অত্যন্ত কম। নিউজিল্যান্ড তার নাগরিকদের এই ইফিসিয়েন্সি ট্র্যাপে আঁটকে রাখতে চায় না, বরং চায় একটি সুস্থ সমাজ বিনিমার্ণ করতে, যেই সমাজে বৈষয়িক সমৃদ্ধির পাশাপাশি গুরুত্ব দিবে মানসিক স্বাস্থ্য আর মানসিক সুস্থতাকেও। অভিবাসন প্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে থাকার এটিও অন্যতম একটি কারণ। বৈশ্বিক জীবনমানের স্ট্যান্ডার্ডে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান ১০ম স্থানে, ১৮৭ টি দেশের মধ্যে।
জীবনমান অত্যন্ত সমৃদ্ধ নিউজিল্যান্ডে; Image Source: World Atlas
জীবনমান অত্যন্ত সমৃদ্ধ নিউজিল্যান্ডে; Image Source: World Atlas
আবহাওয়া
নিউজিল্যান্ডে সাধারণত চারটি ঋতুর উপস্থিতি দেখা যায়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে থাকে বসন্তকাল, এরপর শুরু হয় গ্রীষ্মকাল। মার্চ থেকে শুরু হয় শরত, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে শীতকাল। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে নিউজিল্যান্ডে তাপমাত্রারও উঠা নামে চলে, পরিবর্তন হয় আবহাওয়াও। একেক ঋতুতে নিউজিল্যান্ড আবির্ভূত হয় প্রকৃতির একেক রূপ নিয়ে, একেক ধরনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে। শিক্ষা অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটা বড় অংশই থাকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পার করা শিক্ষার্থী, যারা নিজেদেরকে নিয়ে যেতে চায় শিক্ষার পরবর্তী ধাপে, রাখতে চায় সাফল্যের স্বাক্ষর। সেদিক থেকেও নিউজিল্যান্ড পছন্দের শীর্ষে থাকে, কারণ নিউজিল্যান্ডের রয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এই দেশে, রয়েছে শিক্ষার অবারিত সুযোগ আর সম্ভাবনা। 
চার ঋতুর দেশ নিউজিল্যান্ড; Image Source: Pixabay.
চার ঋতুর দেশ নিউজিল্যান্ড; Image Source: Pixabay.
সাধারণত, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে শিক্ষার সুযোগ নিতে নিউজিল্যান্ডে আসে অভিবাসীরা। নিউজিল্যান্ডের অত্যন্ত ভালো অবস্থান আছে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকেও, ১৮৯ টি দেশের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান ১৪ তম স্থানে। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে এই অবস্থান বলে দেয়, নিউজিল্যান্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ও দক্ষতা ওরিয়েন্টেড। এটি অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে যারা স্থায়ী হতে চায়, তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে।

বিভিন্ন দেশের অভিবাসী
নিউজিল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী রয়েছে যুক্তরাজ্যের, প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার। চিনের অভিবাসী আছে ৯৫ হাজার। ভারতের আছে ৭১ হাজার। পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী আছে ৬৬ হাজার, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৫৭ হাজার। ২০১৯ সালের এই হিসাব অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডে মোট অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ, যেটি মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ।  
আন্তর্জাতিকপ্রবাসনিউজিল্যান্ড
আরো পড়ুন