ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম, সে তালিকায় ব্রিটিশদের সংখ্যা আরো কম। সে তালিকায় স্থান করে নেয়া ব্রিটিশ নারী সামান্থা লিউথওয়েইট যাকে দ্য হোয়াইট উইডো বলে ডাকা হয়, তাকে নিয়েই আজকের আয়োজন। খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া এই নারী, ব্রিটেন এবং কেনিয়ায় বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার সাথে সরাসরি জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। চলুন দেরী না করে শুরু করা যাক।
জুলাই ৭, ২০০৫ ব্যস্ত লন্ডন এ মানুষ ছুটে চলছিলো বাকি দিনগুলোর মতোই জীবিকার তাগিদে। কিন্তু দিনটা বাকি দিনগুলোর মতো করে শেষ হয়নি। সেদিনই লন্ডন কেঁপে ওঠে চারটি সিরিজ বোমা বিস্ফোরণে, যার মধ্যে তিনটি ছিলো মেট্রোরেলে এবং অন্যটি ছিলো একটি ডাবল ডেকার বাসে। ব্রিটেনের ইতিহাসে সেটিই ছিলো প্রথম কোনো আত্নঘাতি বোমা হামলা, যাতে ১৮টি দেশের ৫২ জন মানুষ প্রাণ হারায় এবং প্রায় ৭০০ মানুষ আহত হয়।
সেই আত্নঘাতী চারজনের একজন ছিলেন “জেরামাইন লিন্ডসে” যার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি সামান্থা লিউথওয়েইট এর স্বামী, যাকে এর পরে থেকেই হোয়াইট উইডো বলে ডাকা হয়। প্রচন্ড বুদ্ধিমতী এবং চালাক এই নারী বোমা হামলার পর পুলিশের কাছে নিজেকে নিরপরাধ ,অসহায় নারী হিসেবে নিজেকে দাবী করে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ থেকে পালাতে সক্ষম হয়।
জন্ম পরিচিতি
সামান্থার জন্ম ৫ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে নর্দান আয়ারল্যান্ডের ব্যানব্রিজ নামক ছোট শহরে। তার বাবা এন্ডি লিউথওয়েইট ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা , সামান্থার জন্মের সময় ব্রিটেন তখন আইরিশ বিদ্রোহ দমন করছিলো, এজন্য তার শৈশবের বেশ খানিকটা সময় আয়ারল্যান্ডে কাটে। এরপর তারা তাদের আদি নিবাস বার্কিংহাম এর এলিব্যুরি কাউন্টিতে ফিরে আসেন। তার আশে পাশের প্রতিবেশীরা সামান্থাকে লাজুক, বিনয়ী এবং ভদ্র হিসেবেই জানত। স্কুলে থাকতেই সামান্থা স্থানীয় এক মুসলমান পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, এবং তাদেরই সাহচার্যে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
এই ঘটনার জন্য তার পরিবারের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হয়। সামান্থা ধর্ম নিয়ে আরো জ্ঞানচর্চার জন্য ২০০২ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য লন্ডনে “School of oriental and African studies” এ ভর্তি হন, কিন্তু তিনি পড়াশোনা শেষ করেননি। ২০০৩ সালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার স্বামী লিন্ডসের সাথে তার পরিচয় হয়। তখন ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগ দেয়া নিয়ে, অনেক আন্দোলন হয়, সেখানে তারা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হয়। ২০০৪ এ তাদের প্রথম সন্তান জন্ম হয়।
প্রথম স্বামী লিন্ডসের সাথে সামান্থা
লন্ডন বোমা হামলা
ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেন যোগ দেয়ার পরেই সেখানকার মুসলমানরা সেটার তীব্র প্রতিবাদ করে, যেই সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে ইরাক আফগানিস্তানে ন্যাটো জোট সামরিক হস্তক্ষেপ করে, সেটারই পরিণতি হিসেবে লন্ডন বোমা হামলা হয়। আল কায়েদা সরাসরি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে “জিহাদ” ঘোষণা করলে, তাদের অনুসারীরা উস্কানী পেয়ে যায় এই ধ্বংসযজ্ঞ করার। লন্ডন হামলায় ব্যবহৃত বোমা গুলো সবগুলোই ছিলো ঘরে বানানো বোমা। লিন্ডসে বোমায় আত্নঘাতি হওয়ার সময় সামান্থা সাত মাসের অন্তঃসত্তা ছিলো।
বিস্ফোরণের পর সামান্থার উপর একদম লাইমলাইট চলে আসে, মিডিয়া পুলিশ, আত্নীয় স্বজন সবাই তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলো। সামান্থা খুব চতুরতার সহিত সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেয়। সে মোটামুটি নিজেকে একজন অসহায় নারী হিসেবে প্রমাণিত করতে পেরেছিলো, যে তার স্বামীর কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত ছিলো না। তবে লন্ডন পুলিশ তাকে সন্দেহ করেছিলো, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে গ্রেফতার করতে পারে নি। তারপর পরিবেশ মোটামুটি শান্ত হয়ে যাওয়ার পর সামান্থা বেমালুম গায়েব হয়ে যায় পৃথিবী থেকে।
কেনিয়া!
এরপর কেটে যায় ছয় বছর। তারপর আবার হঠাত করে সামান্থা লিউথওয়েইট এর নাম চলে আসে , এবার সেটা কেনিয়ায়। কেনিয়ার পুলিশ মোম্বাসা শহরে একটি জঙ্গি আস্তানার খোজ পায়, যেখানে তারা বোমা তৈরির উপকরণ পায় যেগুলো লন্ডন বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমা গুলোয় ব্যবহার করা হয়, তদন্ত করতে গিয়ে তারা একজন ব্রিটিশ নাগরিক জন গ্রান্টকে গ্রেফতার করে। সে তার স্বীকারোক্তিতে সামান্থা কে মূল পরিকল্পনাকারী এবং অর্থদাতা বলে চিহ্নিত করে।
এরপর পুলিশ সামান্থাকে ধরতে চিরুনী অভিযান শুরু করে, কিন্তু সামান্থা দেখতে কেমন সেই বিষয়ে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। তারা গ্র্যান্টকে যেখানে আটক করে তার আশ পাশের ভবন গুলিতে অভিযান চালায়, তার একটি ভবনে একজন শ্বেতাঙ্গ নারীকে পায়, সেই নারী নিজেকে সাউথ আফ্রিকান হিসেবে নিজেকে পরিচিত দেয় এবং একটি পাসপোর্ট দেখায় যেখানে তার নাম নাটায়েল ফায়ে হিসেবে দাবী করে।
সামান্থার নকল পাসপোর্ট
পুলিশ আর বেশী তদন্ত না করে ফিরে যায়, পরে গিয়ে দেখা যায় সেই নারীই ছিলো মহা ধুরন্ধর সামান্থা লিউথওয়েইট। পুলিশ পরবর্তীতে সেই বাসায় তল্লাশী চালায়, সেখানে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি, আরেকটি ঠিকানার সন্ধান পায়, যেটা ছিলো মোম্বাসা শহরেইএকটি সমুদ্র সৈকত পাশে রিসোর্টে। তারা ধারণা করছিলো, বড়দিনের ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকদের উপর বোমা হামলা করার পরিকল্পনা করছিলো তারা। এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও সামান্থা হাল ছাড়েনি, এবং ছয় মাস পরেই “জেরিকো বার এটাক” সম্পন্ন করে।
‘জেরিকো বার এটাক’
২০১২ সালের জুন মাস,বন্দর নগরী মোম্বাসায় জনপ্রিয় একটি বার ছিলো এই জেরিকো বার। প্রতি সন্ধ্যায় প্রচুর মানুষ সমাগম হতো, জু্ন এর ২৪ তারিখে তেমন একটি সন্ধ্যায় সেখানে ইউরো ফুটবলের একটি ম্যাচ উপভোগ করছিলেন সবাই। তারপর হুট করেই সব ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়ে গেলো। সে হামলায় তিনজন মারা যায় এবং ৫২ জন আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণণায় তারা একজন শ্বেতাঙ্গ নারীকে ক্লাবে ঢুকতে দেখেন এবং তারপরেই বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। পরে তাদের সামান্থার ছবি দেখানো হলে তারা তাকেই সন্দেহভাজন সেই হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেটাই ছিলো সামান্থা লিউথওয়েইট সম্পর্কে সর্বশেষ জোরালো প্রমান যে তিনি কেনিয়াতেই আছেন। এরপর তাকে দেখতে পাওয়া যায় নি কোথাও।
নাইরোবী শপিং মল হামলা
বন্দর নগরী মোম্বাসা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠার পর চলে যায় বেশ কিছুটা সময়। এরপর সেপ্টেমবর, ১১ , ২০১৩ সালে কেঁপে অঠে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবী। এবার আর বোমা বিস্ফোরণে নয়। এবার বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ওয়েস্ট গেট শপিং কমপ্লেক্সে। এই হামলার দায় স্বীকার করে আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি গোষ্ঠী “আল-শাবাব”। কিন্তু আল শাবাবের সাথে আমাদের আয়োজনের মূল চরিত্র সামান্থার সম্পর্ক কোথায়? সেটার জন্য একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
“জেরিকো বার” এ বোমা হামলার পর, কেনিয়ার পুলিশ তার খোজ পেতে অভিযান চালাতে থাকে, এরমধ্যে একটি অভিযানে তার বেশ কয়েকটি নথি পত্র এবং একটি ল্যাপটপ পায়। সেই নথি এবং ল্যাপটপ গুলোতে সামান্থার জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া যায়। সেই ল্যাপটপে তারা সামান্থার নতুন স্বামী আব্দুল ওয়াহিদ এবং তার চার সন্তানের একটি ছবি পায়। আব্দুল ওয়াহিদ কেনিয়ার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। সেখান থেকে তিনি অব্যাহতি নেয়ার পর জঙ্গী গোষ্ঠী আল শাবাবে যুক্ত হন। পুলিশ ধারণা করে, তার এই স্বামীর মাধ্যমেই তিনি সেই জঙ্গী গোষ্ঠির সাথে যুক্ত হন।
দ্বিতীয় স্বামী আব্দুল ওয়াহিদের সাথে সামান্থা
আল শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠী ২০১২ সালে আল কায়েদার সাথে যুক্ত হয়, এরপর থেকেই তারা আফ্রিকায় ভয়ের ত্রাস সৃষ্টি করেছে। নাইজেরিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া এইসব দেশে তারা প্রায়ই বিভিন্ন ধরণের হামলা পরিচালনা করে আসছে। সোমালিয়ায় ত তারা প্রায় অর্ধেক জায়গা নিজেদের নিয়ন্তণে রেখেছে। পুলিশ ধারণা করে, সামান্থা আল শাবাবের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে রয়েছে। তার পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম চালাচ্ছে আল শাবাব। চলুন এবার নাইরোবীতে ফেরা যাক।
নাইরোবীর সেই আক্রমণে চারজন অস্ত্রধারী শপিং মলের দুই দিক থেকে প্রবেশ করে। সেখানে তারা নির্বিচারে হত্যা যজ্ঞ চালায়। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তুমূল সংঘর্ষের পর তারা নিহত হয়, কিন্তু ততক্ষণে তারা ৬২ জোন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। আহত হয় আরো অনেকে। কেনিয়ার সরকার এই হামলার পেছনে আল শাবাব সহ , সামান্থা লিউথওয়েটকে দায়ী করে। এবং এরপরেই তার নাম ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে চলে আসে।
বর্তমানে কোথায় আছেন?
সন্তানের সাথে সামান্থা (ল্যাপটপ থেকে উদ্ধারকৃত)
সর্বশেষ তথ্য মতে, চার সন্তানের জননী সামান্থা সোমালিয়ায় আল শাবাব অধ্যুষিত এলাকায় বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছেন। উদ্ধাররকৃত ল্যাপটপ এবং ডায়েরী থেকে তার সন্তানদের বিষয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারা যায়। গবেষকরা বলছেন, সামান্থা আল শাবারের একটি নেতৃস্থানীয় জায়গায় আছেন, এবং তার সন্তানেরাও সেই পথেই এগোবে সেটাই তিনি চান। ইউক্রেন সংকটের সময় রাশিয়া তাকে হত্যা করার দাবী করে, কিন্তু সেই বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি তারা।
সামান্থার লেখা ডায়েরী
সামান্থার ছোটবেলার পরিবেশ খুবই সাধারণ কেটেছে, সেই একজন সাধারণ ব্রিটিশ নারী কেন এরকম পথ বেছে নিলো সেটা বিস্ময়কর লেগেছে অপরাধ বিজ্ঞানীদের কাছে। উগ্রপন্থা বা জঙ্গীবাদ কখনোই কোনো ধর্মের শিক্ষা হতে পারে না। ধর্ম সবসময় মানুষকে সহনশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। ধর্মকে ব্যবহার করে এই নারী আর কত দুঃসংবাদ সৃষ্টি করবে অথবা পুলিশের সাথে চোর পুলিশ খেলায় কবে হেরে যাবে, সেটা সময়ই বলে দিবে। ।