আন্তর্জাতিক
আলফ্রেড নোবেল: মৃত্যুর বণিক থেকে মানুষের কল্যাণে সম্পদ উৎসর্গ করে দেয়া বিজ্ঞানী

আলফ্রেড নোবেল। ৬২ বছর বয়সী এই শিল্পপতি মানুষের কল্যাণে যারা কাজ করেছেন তাদের সম্মান জানাতে মৃত্যুর আগে করা উইলে বর্তমান মূল্যে প্রায় ২৬৫ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ দিয়ে যান। অথচ ইতিহাস বলছে, বংশ পরম্পরায় মানুষের ক্ষতিই করে গেছে আলফ্রেডের পরিবার। হটাত কি এমন হলো যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ এমন মহত উদ্যোগে দান করে দিতে চাইলেন তিনি?

১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। আলফ্রেডের বাবা ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার তাই সুযোগ হয়ে ওঠে নি ইমানুয়েলের। তিনি নিজেই কাজ শিখে হয়ে উঠেছিলেন স্ব-শিক্ষিত উদ্ভাবক এবং বিল্ডিং ঠিকাদার। সমস্ত পুঁজি তিনি ব্যয় করেন এই ঠিকাদারি ব্যবসায়। কিন্তু আকস্মিকভাবে আলফ্রেডের জন্মের বছরে তিনি ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েন, হয়ে যান দেউলিয়া। ১৮৩৭ সালে তিনি পাড়ি জমান ফিনল্যান্ডে, পরে স্হায়ী হন রাশিয়ায়। আলফ্রেডের মা আন্দ্রেত্তি তিন সন্তানকে নিয়ে থেকে যান স্টকহোমে। এদিকে আলফ্রেড নোবেলের বাবা ইমানুয়েল সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখান থেকে রাশিয়ান আর্মিদের কাছে বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। ১৮৪২ সালে পরিবারের সবাইকে সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে আসেন ইমানুয়েল। পরের বছরই এই পরিবারে আরেক সন্তান আসে, এমিল। চার ভাইয়ের শিক্ষা জীবন চলতে থাকে প্রাইভেট টিউটরদের কাছে। তাদের কাছে বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং ভাষাজ্ঞানের শিক্ষা নেন চার ভাই। ১৭ বছর বয়সেই আলফ্রেড নোবেল ইংরেজি, সুইডিশ সহ পাঁচ ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেন। আলফ্রেডের অবশ্য আগ্রহ ছিল সাহিত্য, রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে। বাবা ইমানুয়েলের চাওয়া ছিল তার ছেলেরা তার মতোই হবে। তিনি ছেলেকে কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ার বানাতে বাইরের দেশে পড়াশোনা করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আলফ্রেড প্যারিসে চলে যান। সেখানে বিখ্যাত রসায়নবিদ প্রফেসর টি.জে. পেলোজের ব্যক্তিগত ল্যাবে কাজ শুরু করেন তিনি। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় তরুণ ইটালিয়ান রসায়নবিদ আসকানিও সোব্রেরো'র। এর তিন বছর আগে, সোব্রেরো নাইট্রোগ্লিসারিন নামে একটি উচ্চ বিস্ফোরক তরল আবিষ্কার করেছিলেন। এক্সপেরিমেন্টে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়েছিল। এই নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে আগ্রহ ছিল আলফ্রেডের। তিনি নির্মাণ কাজে এটিকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে লাগলেন। পড়াশোনা শেষে রাশিয়ায় ফিরে আসার পর আলফ্রেড তার বাবা ইমানুয়েলের সাথে নাইট্রোগ্লিসারিনকে অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৮৫৩ সালে শুরু হওয়া ক্রিমিয়ান যুদ্ধ বছর তিনেক পর শেষ হলে অন্য অনেকের মতোই ইমানুয়েলের ব্যবসাও ক্ষতির মুখে পড়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সুইডেন ফেরার। আলফ্রেডের বড় দুই ভাই পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার জন্য থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ায়।

১৮৬৩ সালে দুই ভাইকে ছাড়া আলফ্রেড তার পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে ফিরে আসেন জন্মস্থান সুইডেনে। নাইট্রোগ্লিসারিনকে শক্তিশালী বিস্ফোরক হিসেবে তৈরির কাজে ফের মনোযোগী হন তিনি। কিন্তু এটি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিস্ফোরণ ঘটে, মারা যায় আলফ্রেডের ছোট ভাই এমিলসহ আরও সাত জন। এর প্রেক্ষিতে সুইডিশ সরকার পরীক্ষাগুলো স্টকহোম শহরের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আলফ্রেড নোবেল বসে ছিলেন না। এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য তিনি বেছে নেন সুইডেনের একটি হ্রদ, ম্যালারেনকে। ১৮৬৪ সালে তিনি নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যাপক উৎপাদনে যান। উৎপাদনকে আরও সুরক্ষিত করতে তিনি অবশ্য তখনও বিভিন্ন উপাদানের সংযোজনে তার এক্সপেরিমেন্ট চালাতে থাকেন। আলফ্রেড তাঁর এই এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে দেখেন, কেজেলগুহর নামক একটি সূক্ষ্ম বালির সাথে নাইট্রোগ্লিসারিন মিশ্রিত করলে তরলটি পেস্ট বা মণ্ডে পরিণত হয় যেটি সিলিন্ডার শেপ ধারণ করে। এটি খনির জন্য ব্যবহৃত ড্রিলিং গর্তগুলোতে সন্নিবেশ করা যেত। ১৮৬৬ সালে এভাবেই হয় ডায়নামাইট আবিষ্কার। তিনি একটি ডিটোনেটর বা ব্লাস্টিং কাপও উদ্ভাবন করেন যা ফিউজ জ্বালিয়ে বন্ধ করা যেতো। এই আবিষ্কারগুলো এমন এক সময়ে করা হয়েছিল যখন সাধারণ কাজে ডায়মন্ড ড্রিলিং ক্রাউন এবং নিউম্যাটিক ড্রিল ব্যবহার করা শুরু হয় ।

একসাথে, এই আবিষ্কারগুলো ড্রিলিং টানেল, ব্লাস্টিং রকস বা সেতু নির্মাণের মতো নির্মাণ কাজগুলোর ব্যয় হ্রাস করতে সহায়তা করেছিল।
এই ব্যয় হ্রাসই আলফ্রেডের ভাগ্য বদলে দেয়। চাহিদা বাড়তে থাকে তার আবিষ্কৃত ডায়নামাইট ও ডিটোনেটিং ক্যাপের। চাহিদা মেটাতে বিশ্বের প্রায় ৯০টি আলাদা স্হানে ফ্যাক্টরি খোলেন আলফ্রেড। প্যারিসে বাস করেও বিশটিরও বেশি দেশে তাকে তাই নিয়মিত যাতায়াত করতে হতো ফ্যাক্টরি দেখভালে। শুধু ডায়নামাইট কিংবা ডিটোনেটরে আটকে থাকতে চান নি, আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসে ছিল তাঁকে। নিয়মিত নানা ধরণের পরীক্ষাও করতেন তিনি। সিনথেটিক রাবার, চামড়া ও কৃত্রিম রেশম তৈরিতেও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। আলফ্রেডের মৃত্যুর পর দেখা গেল, তাঁর ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট আছে।
আলফ্রেড নোবেল চিরকুমার থেকেছেন, তাঁর নিজের বলে কোনো পরিবার ছিল না। নিজের পরিবার পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদেরই তাই সমস্ত সম্পদ দান করে দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু হটাত করেই তাঁর মত পরিবর্তন হয়।
অনেকেরই বিশ্বাস ১৮৮৮ সালের একটি ঘটনা তাঁকে বদলে দিয়েছিল।

সে বছর আলফ্রেডের বড় ভাই লুডভিগ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। কিন্তু ভুলবশত ফরাসি একটি সংবাদপত্র আলফ্রেড নোবেলই মারা গিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পত্রিকাটি আলফ্রেডকে "মৃত্যুর বণিক" হিসাবে আখ্যায়িত করে বলে, "বিভ্রান্ত ও হত্যার" নতুন উপায় তৈরি করে আলফ্রেড ধনী হয়েছিলেন। এই ভুল সংবাদ পরে সংশোধন করে নিয়েছিল পত্রিকাটি কিন্তু আলফ্রেডের চোখে ঠিকই পড়ে যায় নিজের মৃত্যুর খবর। আলফ্রেড খবরটি পড়ে মুষড়ে পড়েন। ঘটনাটি তাঁর কাছে বিবেকের সংকট হয়ে এসেছিল এবং তাঁকে তাঁর ক্যারিয়ারের মূল্যায়ন নতুনভাবে করতে প্ররোচিত করেছিল। নোবেল "তাঁর মরণোত্তর খ্যাতিতে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি তার শেষ ইচ্ছাটি পুনর্লিখন করেছিলেন এবং তার সম্পদের বেশিরভাগ অংশকে এমন একটি কারণে দান করেছিলেন যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে পত্রিকা বা লেখার কোনো মাধ্যমে কোনো লেখক বা সাংবাদিকের জন্য বিশেষণ ব্যবহারে সুবিধা হয়।" ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসের সুইডিশ-নরওয়েজিয়ান ক্লাবে বসে জীবনের শেষ উইল এবং টেস্টামেন্টে স্বাক্ষর করেন আলফ্রেড নোবেল। ৬২ বছর বয়সী এই শিল্পপতি মানুষের কল্যাণে যারা কাজ করেছেন তাদের সম্মান জানাতে উইলে বর্তমান মূল্যে প্রায় ২৬৫ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ দিয়ে যান। বলে যান, পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য এবং শান্তি বিষয়ে যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন তাদেরকে প্রতিবছর পুরষ্কৃত করতে। সবাই অবশ্য এই উইলে সন্তুষ্ট ছিল না। তাঁর স্বজনরা এটির বিরোধিতা করেছিলেন অথচ কাউকেই তিনি বঞ্চিত করেন নি। ১৯০১ সালে প্রথমবার নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। আলফ্রেডের ঠিক করে যাওয়া পাঁচটি ক্যাটাগরীর সাথে ১৯৬৮ সাল থেকে অর্থনীতিতেও নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়।

শেষ উইলে স্বাক্ষরের পর মাত্র এক বছর বেঁচে ছিলেন আলফ্রেড। ১৮৯৫ সাল থেকেই শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি, ছিল হৃদযন্ত্রের সমস্যাও। ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ৬৩ বছর বয়সে ইটালির সানরেমোর নিজ ভিলাতে সেরিব্রাল হেমোরেজে মারা যান আলফ্রেড। তাঁর সম্মানে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর দিনে নোবেল পুরস্কারের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।