মাতৃভাষা বাংলা: প্রতিনিয়ত যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ভুল বানান
জাতীয়
মাতৃভাষা বাংলা: প্রতিনিয়ত যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ভুল বানান
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো’। মাতৃভাষাকে ছোট করা মানে মাকে ছোট বা হীন করা। মাতৃভাষা একটি জাতির হৃদয়। মানুষের আত্মা। 
কাউলা, এয়ারপোর্ট রোড। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
কাউলা, এয়ারপোর্ট রোড। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
বাঙালি জাতির হৃদয়কে হরণ করতে ১৯৫২ সালে বর্বরতার মিশন চালিয়েছিল পাকিস্তান। সেই মিশন ব্যর্থ করতে মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন একদল তরুণ। শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে। ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন পৃথিবীর বুকে এটা বিরল ঘটনা। ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলার দামাল সন্তানদের এই আত্মত্যাগকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। দেশেও প্রতি বছর ভাষা শহীদদের স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী পালিত হয় গ্রন্থমেলা। এসব স্বীকৃতি আর উদযাপনের সফলতাকে মলিন করে দিচ্ছে মাতৃভাষার ভুল বানানের ছড়াছড়ি। আর এই ভুল বানান ছড়ানোতে প্রতিনিয়ত মূখ্য ভূমিকা পালন করছে মানুষকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা সংক্রান্ত সাইনবোর্ড, ব্যানারের ভুল বানান পথচারীদের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে। ছড়াচ্ছে বাংলা বানানে বড় ধরনের বিভ্রান্তি। সেবার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত মানুষকে ভুল বানানের সার্ভিস দিচ্ছে তারা। প্রসার হচ্ছে ভুল বানান। কেননা প্রচারই প্রসার। 
জসিমউদ্দিন মোড়, উত্তরা। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
জসিমউদ্দিন মোড়, উত্তরা। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে সবাই মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ জেগে তুলি কিন্তু সারা বছরের কাজকর্মে সেই আবেগের উপস্থিতি থাকে না। বাংলা ভাষার গৌরবের প্রকাশ ঘটতে পারত রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে এই ভাষার সঠিক প্রচলনের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। বরং শিক্ষাক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে বাংলা ভাষা অবহেলার শিকার। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্র। উত্তর ঢাকা জসিমউদ্দিন মোড়ে পুলিশ চেক পোস্ট সাইনবোর্ডের বানানে ভুল বানান প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। তাতে পোস্ট এর জায়গায় পোষ্ট লেখা হয়েছে। ইংরেজি বানানে শব্দের প্রয়োগটি সঠিক হয়নি। শুধু ওই সাইনবোর্ডে নয়, এ রকম অনেক জায়গায় পোস্টের বদলে পোষ্ট শব্দের ব্যবহার করতে দেখা যায়। 
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডের ওপর সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি পড়ে মানুষের। ওসব প্রতিষ্ঠান থেকে সবাই সব সময় সেবা গ্রহণ করে থাকে। সেবার পাশাপাশি তাদের থেকে বাংলা ভাষার ভুল বানানেরও সেবা নিচ্ছে সেবাগ্রহীতরা। ইষ্টার্ন বানানটি ভুল। হবে ইস্টার্ন। যতোদিন পর্যন্ত সাইনবোর্ড থেকে ভুল বানানটি না সরবে ততোদিন সবাই ভুলটাই দেখতে থাকবে আর সর্বত্র ভুল ছড়িয়ে পড়বে। যদিও পুস্তকে সঠিক রূপ ‘ইস্টার্ন’ লেখা আছে। 
জসিমউদ্দিন মোড়, উত্তরা। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
জসিমউদ্দিন মোড়, উত্তরা। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
এখানে একই শব্দে অন্য জায়গায় ভুল করেছে। ইস্টার্ণ বানান না হয়ে হবে ইস্টার্ন। এক শব্দের বানানে দুই প্রতিষ্ঠান দুইভাবে ভুল ছড়াচ্ছে। বানানে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। যে যার মতো করে শব্দের বানান প্রয়োগ করছে। 
রাজধানীর নতুন বাজার। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
রাজধানীর নতুন বাজার। ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ভুল বানান ছড়ানোর ভূমিকা কেবল এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই পালন করছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এগিয়ে। আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের কথা বলি। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা বলে থাকি। কিন্তু সে ভূমিকা কি আমরা পালন করছি? যদি তাই করতাম তাহলে ষ্টাফ বাসের জায়গায় স্টাফ বাস লিখতাম। ভুল বানানের সাইনবোর্ড লিখে ভুল ছড়ানোর সার্ভিস দিয়ে যেতাম না। 
শুধু হাতের লেখা সুন্দর করলেই হবে না। বরং শুদ্ধভাবে লিখতে হবে। শুদ্ধ ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বই পুস্তকে শুদ্ধরূপ আঁকা থাকলেও দেয়ালে, সাইনবোর্ডে ভুল বানানে আকা শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে প্রকাশ্যে রঙ বেরঙের মোটা অক্ষরে ভুল বানানে লিখলে এক সময় শুদ্ধ বানান আঁকা শব্দটি হারিয়ে যাবে। 
ওপরের ভুলটাকে সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল বলা যায়। কারণ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লেখাটি লিখিত রয়েছে দেশের পবিত্র সংবিধানে। এটাকে ভুলভাবে ‘গনপ্রজাতন্ত্রী.....’ লেখা সংবিধান লঙ্ঘনের সমতুল্য। এসব ভুল বানানকে গুরুতর মনে না করায় যে যার মতো করে ভুল বানানে লিখে যাচ্ছে। আর দ্রুত সবার মাঝে ভুল ছড়িয়ে যাচ্ছে।  
ভুল তো ভুলই। ভুলকে ছোট চোখে দেখলে সর্বত্র ভুল ছড়িয়ে পড়বে আর সবাই ভুল লিখতে থাকবে। আজ জসিমউদ্দিন মোড়ে ভুলভাবে ‘কল্যান’ লিখবে। কিছুদিন পরে এটা দেখে রাজশাহীর উপশহরের ভদ্রা এলাকার মোড়ে ‘কল্যান’ লিখবে। এক সময় সঠিক বানান ‘কল্যাণ’ শব্দটি শুধু ডিকশনারিতেই রয়ে যাবে।
এক বিজ্ঞাপনেই তিন ভুল। এসব বিজ্ঞাপন শুধু চিকিৎসার সার্ভিস প্রচার করছে না বরং তারা জোরালোভাবে ভুল বানানের সার্ভিস দিচ্ছে। যারাই বিজ্ঞাপনটি দেখছে তারা ‘দূর্বলতায়, কোমড়, গ্যাষ্টিক’ এসব ভুল বানানের সার্ভিস নিচ্ছে। বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করছে। ফলে বাংলা ভাষা থেকে আস্তে আস্তে ‘দূর্বলতায়, কোমর, গ্যাস্ট্রিক’ শুদ্ধরূপ হারিয়ে যাবে। বিভ্রান্তি ছড়াবে এসব শব্দের বানানে।  
এতো বহুল প্রচলিত শব্দের ভুল বানান লেখা খুবই হতাশার ও বাংলা ভাষার বানানে নৈরাজ্যের বিষয়টি ফুটে ওঠে। ‘সরকারি-বেসরকারি, মন্ত্রণালয়’ শব্দ তিনটির সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। লিখন ও পঠনেও বহুল উচ্চারিত। কতটা ভাষার প্রতি উদাসীন হলে ভুল বানানে সাইনবোর্ডে ‘সরকারী-বেসরকারী-মন্ত্রনালয়’ লেখা হয়। বলা হয়ে থাকে, ভাষা বেঁচে থাকে লালনে, যত্নে। আর হারিয়ে যায় অবহেলায়, উদাসীনতায়। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছি আত্মত্যাগে। সেই স্বীকৃতি ধরে রাখতে হলে এক সাইনবোর্ডে তিন বানান ভুল কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এভাবে প্রকাশ্যে ভুল বানানের সার্ভিস দেয়া ভাষা শহীদদের সাথে অশ্রদ্ধার শামিল বলে মনে করছেন ভাষা বিশেষজ্ঞরা। 
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দ এসেছে বিদেশি ভাষা থেকে। ‘রেস্তোরাঁ’ শব্দটি ফারসি ভাষার শব্দ। শব্দটি বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। এই বিদেশি ‘রেস্তোরা’ শব্দের ভুল বানানে লেখা হয়েছে ব্যানারটিতে। একই বানানে আরও অনেক জায়গায় ব্যবহার হতে দেখা গেছে। এটা মূলত এভাবে ভুল বানান ব্যবহার করার কারণে দেখাদেখি সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। উদাসিনভাবে ‘রেস্তোরা’-এর ভুল ব্যানারগুলো ভুল বানানের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।
ব্যানারটি ‍দেখলে মনে হচ্ছে তারা ভুল বানানের সার্ভিস দেয়ার জন্য মানববন্ধন করছে। এভাবে ভুল বানানের ব্যানার নিয়ে প্রকাশ্যে মানববন্ধন করা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল। ‘দুর্ঘটনা রোধে ওভারব্রিজ’ এর দাবি করলেও মানববন্ধনের ব্যানার থেকে ‘দূর্ঘটনা ও ওভারব্রীজ’ এর ভুল বানান প্রচার করা হচ্ছে। যা দ্রুত বাংলা ভাষার বানানে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এতোক্ষণ পর্যন্ত গেল ভুল বানানের একটি ছোট নমুনা। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা, সেবা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ভুল বানানে সয়লাব হয়ে গেছে। বছরের পর বছর প্রতিনিয়ত তারা ভুল বানানের প্রচার করে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, প্রচারই প্রসার। এভাবে ভুল বানান প্রসারে বাংলা বানানে বিভ্রান্তি ছড়াতে ব্যাপকহারে ভূমিকা রাখছে।
একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা, সাধনা, জ্ঞান-গরিমা দিয়ে অর্জন করতে হয়। চর্চা ও সচেতনতার মাধ্যমে মাতৃভাষাকে বিকাশ ও জীবন্ত রাখতে হয়। কেননা একমাত্র মাতৃভাষা দিয়েই জীবন ও আত্মাকে বেশি উপভোগ করা যায়। আর রাষ্ট্রভাষা শুধু সংবিধানে থাকলে হবে না, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে তার শুদ্ধ ও সক্রিয় ব্যবহার থাকা দরকার। এজন্য প্রয়োজন ‘জাতীয় ভাষানীতি’। নচেৎ দেশে প্রতি বছর রাষ্ট্রভাষা উদযাপন, রাষ্ট্রভাষা পদক ও মাসব্যাপী মেলা চলবে কিন্তু বন্ধ হবে না মাতৃভাষার ভুল বানানের সার্ভিস। এজন্য ভাষাসংগ্রামী লেখক-গবেষক আহমদ রফিক বলেছেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
জাতীয়বিশেষ প্রতিবেদনরাজধানী
আরো পড়ুন