ঐতিহাসিক খাবার বিরিয়ানি: কীভাবে এলো আপনার প্লেটে?
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বহু শতাব্দী ধরে সর্বোচ্চ তৃপ্তি নিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে আসছে বিরিয়ানি। তবে, আপনি কি জানেন এর পারস্য থেকে আপনার প্লেটের যাত্রা? বিরিয়ানি শব্দটি ফারসি শব্দ বিরিয়ান থেকে উদ্ভৃত, যার অর্থ ‘রান্নার আগে ভাজা’ এবং ধানের ফারসি শব্দ বিরিঞ্জ। তো ধান থেকে চাল, আর চালকে বিভিন্ন মসলা দিয়ে ভাজা, এরকম করে উপকরণ এবং রন্ধন প্রণালীর সম্মীলনে উদ্ভব হয়েছে বিরিয়ানি নামের। এই জাঁকজমকপূর্ণ থালাটির উত্স সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে বিরিয়ানি পারস্য থেকে উদ্ভূত এবং মোঘলদের দ্বারা ভারতে এসেছে। বিরিয়ানির আরও বিকাশ হয়েছিল মোঘল রাজ রান্নাশালায়।
কিংবদন্তী:
বিরিয়ানির বিবর্তনের সাথে অনেক কিংবদন্তী যুক্ত রয়েছে। শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহল সম্পর্কিত গল্পটি এদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় গল্প। জানা যায় যে একবার মমতাজ যখন সেনাবাহিনীর ব্যারাক পরিদর্শন করছিলেন, তিনি খেয়াল করলেন যে, মোঘল সৈন্যদের বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। স্পষ্টতই এই দুর্বল অবস্থা দেখে মমতাজ এটি সমাধানের জন্য নিজেই এক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। তাঁর নিজস্ব যুক্তি বলছিলো যে সেনারা দুর্বল হলে তো দুর্বল হচ্ছে ভারতের নিরাপত্তাই। তিনি তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে সজ্ঞাত ছিলেন। তাই সৈন্যদের সুষম খাদ্য সরবরাহ করার উদ্দ্যেশ্যে, তিনি সৈন্যশিবিরের বাবুর্চিদের মাংস এবং ভাত দিয়ে বিশেষ এক খাবার পদ প্রস্তুত করতে বলেন, যা বিভিন্ন প্রকার মশলা মিশিয়ে এবং জাফরান ছড়িয়ে দিয়ে কাঠের আগুনে রান্না করা হয়।
আর একটি কিংবদন্তি আছে, বলা হয় যে ১৩৯৮ সালে তুর্কি-মঙ্গোল বিজয়ী তাইমুর লং ভারতে নিয়ে এসেছিলেন বিরিয়ানি। এমনকি হায়দারাবাদের নিজাম পরিবার এবং লখনৌয়ের নবাবদের কাছে খুব সমাদৃত এবং প্রশংসনীয় হওয়ার জন্যও এই সুস্বাদু পদটি আরও পরিচিতি পায়।
ঐতিহ্যগতভাবে, বিরিয়ানি মাটির পাত্রে কাঠকয়লার উপরে রান্না করা হত। আজ, বিভিন্ন ধরণের এবং বিভিন্ন স্বাদের হরেক রকম বিরিয়ানি রয়েছে যা বেশিরভাগ ভারতীয় এবং উপমহাদেশীয়দের উদরপূর্তির এক প্রিয় মুখরোচক থাল; যেখানে সবাই এক, যে স্বাদে সবার পছন্দ এক।
চলুন অন্বেষণ করে আসা যাক উপমহাদেশ জুড়ে খুব জনপ্রিয় বিভিন্ন প্রকারের বিরিয়ানির সেকাল থেকে একালের মুখরোচক যাত্রায়:
মোঘলাই বিরিয়ানি
মোঘল সম্রাটরা আড়ম্বরপূর্ণ ভোজনভোজী অভিজ্ঞতা নিতে খুব পছন্দ করতেন এবং রান্নার বিভিন্ন শিল্পের বেশ সমাদর এবং প্রশংসা করতেন। ঐতিহ্যবাহী মুঘলাই বিরিয়ানি তৈরি হতো টুকরো টুকরো মাংসের সাথে কেওরার সুগন্ধযুক্ত চাল দিয়ে পুরোপুরি মশলাযুক্ত করে রান্না করে, যা থেকে এমন উদ্ভূত হত এমন দুর্নিবার সুস্বাদু মুখরোচক সুগন্ধ যা যে কাউকে তাত্ক্ষণে ক্ষুধার্ত করতে পারে।
লখনৌ বিরিয়ানি
লখনৌয়ের বিরিয়ানি ‘পুকি’ বিরিয়ানি নামে পরিচিত। 'পুকি' স্টাইলে মাংস এবং চাল আলাদাভাবে রান্না করা হয় তারপরে একটি তামাটে পাত্রে স্তরে স্তরে রেখে পরিবেশিত হয়। এটি আবার আধি/আওয়াধি বিরিয়ানি নামেও পরিচিত, রান্নাটি বহুলাংশে প্রভাবিত হয় আওয়াধের নবাবদের দ্বারা, যারা পার্সিয়ান বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাদের নাম থেকেই প্রভাবিত এই আওয়াধি বিরিয়ানি নাম।
কলকাতা বিরিয়ানি
ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ পুনরায় কলকাতা শহরে বিরিয়ানি তৈরি ও এর প্রচলন শুরু করেন। কিন্তু তখন সেখানে তারা মাংস দিতে অসমর্থ হওয়ায়, স্থানীয়রা এই পদ রান্না করতে মাংসের পরিবর্তে ভালোভাবে রান্না করা সোনালি বাদামী আলুর ব্যবহার শুরু করে। এই কলকাতা বিরিয়ানিতে মসলার ব্যবহার কম, বরং এতে বিরিয়ানির মাংসকে দই দিয়ে মেরিনেড করা হয়, যেটা হালকা হলুদ পোলাউ থেকে আলাদাভাবে রান্না করা হয়।
বোম্বে বিরিয়ানি
মশলাদার, হৃদয়গ্রাহী এবং রুচিবর্ধক মুখরোচক স্বাদযুক্ত, বোম্বাই বিরিয়ানি হল স্বাদের এক গলানো গামলা। শুকনো বরই এবং কেওড়া জলের ব্যবহার এটিতে যুক্ত করে সামান্য মিষ্টতাও।
হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি
বিখ্যাত হায়দরাবাদী বিরিয়ানি প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজা-উল-মুলককে হায়দারাবাদের নতুন শাসক নিযুক্ত করার পরে । এরকমটা বিশ্বাস করা হয় যে তাঁর শেফরা বিরিয়ানির প্রায় ৫০ টি বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেছিলেন যা মাছ, চিংড়ি, কোয়েল, হরিণ এবং এমনকি খড়ের/ খরগোশের মাংস ব্যবহার করে। সুগন্ধি জাফরান এই খাবারের পদটির এক সৌন্দর্য তারকা। খনিত কোহিনূর হীরার পরে হায়দরাবাদ এই বিরিয়ানির জন্যে বিখ্যাত। এটা বলা যায় যে বিরিয়ানিটা হায়দরাবাদের এক সমার্থক হয়ে উঠেছে এত ওতপ্রোত যে আপনি যখন একটার কথা ভাবেন তখন সাথে সাথে অন্যটিকে ভাবতে বাধ্য হন।
ব্যাঙ্গালোরিয়ান বিরিয়ানি
বেশিরভাগ ব্যাঙ্গালুরো বিবাহে এবং বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্না হয় এই বিশেষ বিরিয়ানি, এটি কেবল বিশেষ জিরা সাম্বা চাল ব্যবহার করে প্রস্তুত করা হয়।
থ্যালাসেরি বিরিয়ানি
মিষ্টি এবং মজাদার, থ্যালাসেরি বিরিয়ানিটা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় বিরিয়ানির মধ্যে একটি। নরম মুরগির পাখনা, হালকা মালবার মশলা এবং কাইমা ভাত ব্যবহার করা হয় এই বিরিয়ানি রান্না করতে।
তথ্যসূত্র:
- https://globalvoices.org/2019/02/16/biryani-stories-in-search-of-the-origin-of-biryani/
- https://indiacurrents.com/tracing-the-history-of-biryani/
- https://www.indiatimes.com/lifestyle/story-of-how-a-mughal-queen-invented-biryani-a-dish-that-unites-the-foodies-of-entire-india-357997.html?fbclid=
- https://en.wikipedia.org/wiki/Biryani