প্রাইভেটকারের ৬ শতাংশ যাত্রীর দখলে রাজধানীর ৭৬ শতাংশ সড়ক
জাতীয়
প্রাইভেটকারের ৬ শতাংশ যাত্রীর দখলে রাজধানীর ৭৬ শতাংশ সড়ক
দিনকে দিন রাজধানীতে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কমে আসছে পরিবহনের গতি। ক্রমেই থমকে পড়ছে নগরজীবনের চাকা। চলতি মাসে উত্তর ঢাকায় কল্পনাতীতভাবে বেড়েছে যানজট। দেখা গেছে, আব্দুল্লাহপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতে সময় লাগছে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। মূলত প্রধান সড়কের গণপরিবহন থামিয়ে ইউটার্ন সৃষ্টি করে প্রাইকেটকার চলাচলের সুযোগ করে দেয়ায় উত্তর ঢাকায় যানজটের প্রধান কারণ। অতিরিক্ত প্রাইভেটকার সড়কের অধিকাংশ সড়ক দখল করায় যানজট লাঘবে বাধ্য হয়ে প্রধান প্রধান সড়কে প্রাইভেটকারের জন্য আলাদা ইউটার্ন সৃষ্টি করতে বাধ্য হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ।  
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
সরকারি সংস্থা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে রাজধানীতে চলাচলের জন্য ১০ হাজার ৮২৫টি প্রাইভেট গাড়ি নিবন্ধন নিয়েছে। গড়ে দিনে ৭২টি প্রাইভেটকার যোগ হচ্ছে রাজধানীর সড়কে। চলতি বছরে জিপগাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে ৬ হাজার ৬৪৮টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৯২৭। আর গত বছর প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হয়েছিল ১৪ হাজার ৩২১টি। পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রাইভেটকার ও জিপের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহ্রত ছোট আকারের এই গাড়িগুলো ঢাকার রাস্তার প্রায় ৭৬ শতাংশ জায়গাই দখল করে আছে। এতে করে প্রতিদিনই নগরবাসীকে তীব্র যানজটের মুখে পড়তে হচ্ছে।
প্রাইভেটকারের দখলে রাজধানীর সড়ক
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ফেলোদের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ঢাকার সড়কের ৭৬ ভাগ প্রাইভেটকারের দখলে। কিন্তু প্রাইভেটকারে যাত্রী মাত্র ৬ শতাংশ। বুয়েটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাইভেটকার এবং এতে যাত্রী বাড়ছে। ২০১৫ সালে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ যাত্রী প্রাইভেটকার ব্যবহার করতেন। ২০২৫ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ১১ দশমিক ১২ শতাংশে।
রাজধানীর সড়কের ধারণক্ষমতা
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কে সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলতে পারে। অথচ এখন পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ১৭ লাখের বেশি গাড়ি। বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছিল পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭টি গাড়ি। এখন (গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত) তা বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি । ঢাকায় নিবন্ধিত ২০ ধরনের গাড়ির মধ্যে ছোট গাড়ির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ সরেজমিনে একটি জরিপ করে দেখেছে, ৩টি ব্যক্তিগত গাড়ি ১২ জন ব্যক্তি নিয়ে যে স্থান দখল করে ঠিক সেই স্থানে ৩৬ জন থেকে ৪০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার একটি বাস স্থান নিতে পারে।
পরিবেশ দূষণে ব্যক্তিগত গাড়ি
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০১৮ সালে ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার পেছনে যে দু’টি অন্যতম কারণ কাজ করেছে সেগুলো হলো যানজট এবং দূষণ। যানজটের কথা আগেই বলেছি। পরিবেশ দূষণের অন্যতম বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত গাড়ির কালো ধোঁয়া। বাংলাদেশের বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলছেন, ” রাজধানীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনের একটি বিরাট অংশ বায়ু দূষণ করছে। নির্গত করছে কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং ওজোন গ্যাস।” ঢাকার দীর্ঘ যানজটে গণপরিবহন ও এসি নেই এমন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ রাখা সম্ভব হলেও এসি আছে এমন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ রাখা হয় না। এমন গাড়ির তালিকায় অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। এতে করে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। নামবিও গবেষণা সূচক বলছে, কার্বন নিঃসরণে এই বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। গেল বছর ছিল ১১৪ তম। তবে করোনার আগে ২০১৯ সালে ভয়াবহ অবস্থান ছিল শহরটির, সে বছর অবস্থান ছিল ৩২। 
যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীতে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, গতি ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার। বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটে। বছরে ক্ষতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি হবে এক কিলোমিটার। প্রাইভেটকার বৃদ্ধির জন্য ভ্রান্ত নীতিকে দায়ী করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক। তিনি বলেন, বাসের গতি বাড়াতে উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণে সুবিধা হয়েছে প্রাইভেটকারের। সাধারণ মানুষ প্রাইভেটকারে ঝুঁকেছেন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংক একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিল। গবেষণায় বিশ্বব্যাংক বলছে, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার। বিশ্বব্যাংকের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ।
ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর উপায়
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, রাস্তা যত বাড়বে, প্রশস্ত হবে, গাড়িও তত বাড়বে। সড়ক বৃদ্ধি যানজটের সমাধান নয়। যানজট কমাতে প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। আর এটি গণপরিবহন উন্নত হলেই সম্ভব হবে। সুশৃঙ্খল ও উন্নত গণপরিবহন না থাকলে প্রাইভেটকারের যাত্রীরা কখনও বাসে উঠবেন না। মেট্রোরেলেও উঠবেন না। প্রাইভেটকার বাড়তেই থাকবে। ২০১৯ সালে কার্যকর সড়ক পরিবহন আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, কোনো ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান বা কোনো এলাকার জন্য মোটরযান রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বা সীমা নির্ধারণ করতে পারবে। প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ আনা হবে। দ্বিতীয় ধাপে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে। প্রথম পদক্ষেপ হবে গাড়ি আমদানিতে ট্যাক্স বাড়ানো। পার্কিং চার্জ বাড়াতে হবে। ব্যস্ত এলাকায় প্রবেশের জন্য আলাদা ফি আদায় করতে হবে। গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ির জ্বালানির দাম কয়েকগুণ বাড়াতে হবে । ব্যক্তিগত গাড়িতে নতুন করে আর কোনও সিএনজি সংযোগ না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি পরিবার কতটি গাড়ি রাখতে পারবে, তাও নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। আমাদের সরকারও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ।
সচেতনতা বাড়ানো
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
১৯৬২ সাল থেকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরের সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য উন্মূক্ত করা হয়। এরপর ইউরোপে এই ধারণাটির প্রসার ঘটতে শুরু করে। সত্তরের দশকে জ্বালানী তেলের সংকটের সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানোয় উৎসাহিত হতে দেখা গিয়েছিল বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের জনগণকে। এরপর নব্বইয়ের দশকে ইউরোপের দেশগুলোতে এমন একটি দিবসের ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি প্রথম পালনের উদ্যোগ নেয়া হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে, ১৯৯৯ সালে। পাইলট প্রজেক্টটির সফল আয়োজন দিবসটির আনুষ্ঠানিক উদযাপনে উৎসাহিত করে আয়োজকদের।পরের বছর সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিবছর ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হবে। ২০০১ সালের বিশ্বের ৩৩টি দেশের প্রায় ১ হাজার শহরে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। এখন প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৪ হাজার শহরে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।এমন বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার পালিত হবে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য 'জ্বালানি ব্যবহার ও যানজট নিয়ন্ত্রণ করি, ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিত রাখি'। 
বাংলাদেশে আয়োজন
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
ছবি: রিদ্মিক নিউজ
২০০৬ সাল থেকে বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন শুরু হয়। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এর সমন্বয়ে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ঢাকা শহরের মানিক মিয়া এভিনিউ এ বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ২০১৭ সালে সরকারি-বেসরকারি ৪৯টি সংগঠন এবং ২০১৮ সালে সরকারি-বেসরকারি ৫১টি সংগঠন এবং ২০১৯ সালে সরকারি-বেসরকারি ৫৯টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদযপান করা হয়। বাংলাদেশে দিবসটির মূল আয়োজন করে থাকে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। বাংলাদেশে সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আয়োজনে প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণে শোভাযাত্রা, সভা-সেমিনারের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি থাকলেও শক্ত পদক্ষেপ নেই। 
জাতীয়বিশেষ প্রতিবেদনরাজধানীযানজট
আরো পড়ুন