দুর্গন্ধ ছাড়িয়ে সুগন্ধির যুগ: অতীত সভ্যসমাজে সুগন্ধি ব্যবহারের অজানা কথা
আন্তর্জাতিক
দুর্গন্ধ ছাড়িয়ে সুগন্ধির যুগ: অতীত সভ্যসমাজে সুগন্ধি ব্যবহারের অজানা কথা
image source: bigthink
image source: bigthink
অনেক ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তিই অতীতে ঘুরতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। মধ্যযুগীয় সভ্যতা থেকে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত সভ্যতার মাঝে যে ফারাক তা নিয়ে শিক্ষিত সমাজের কৌতুহল অনেক বেশি। কারণ আজকে আমরা যা কিছু দেখি, যত বড় বড় নগর, শহর কিংবা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুর শুরুটা কিন্তু আরো দুই থেকে আড়াইশত বছর আগে সৃষ্টি। যদিও অতীতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন এখন অবধি কেউ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শুধু সমসাময়িক লেখক, ইতিহাসবিদ এবং বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কাজের মাঝেই সে সময়ের প্রকৃত রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক ইউরোপিয়ান পরিচালকও তাদের টিভি সিরিজ কিংবা সিনেমায় শত বছর আগের ইউরোপ, আমেরিকার চিত্র দেখানোর চেষ্টা করেন। কল্পনা বা সিনেমায় সে সময়টা ঠিক যতটা ঐতিহাসিক এবং সুন্দর মনে হয় প্রকৃতার্থে কি তেমন ছিল? এই বিষয়গুলো নিয়ে জানা অত্যন্ত জরুরী। তখনকার সমাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বৈষম্য সহ নানান রকম সমস্যায় জর্জরিত ছিল সমাজ। আর এই পার্থক্যের কারণে নগরায়ন, পরিবেশসহ জীবনযাত্রার বিষয়গুলো ছিল অনেকটাই প্রতিকূল। তখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এতই অভাব ছিল যে আপনি চাইলেও অনেক বিখ্যাত শহরে সহজে ভ্রমণ করতে যেতেন না। যদিও বর্তমান সময়ের রুচিশীল মানুষ ওই সমাজে বেড়ে উঠলে হয়তো সেখানকার পরিবেশে খাপখাইয়ে নিতেন।
ইতোমধ্যেই আমরা মারাত্মক এক মহামারি মোকাবেলা করেছি। কিন্তু মহামারীতে জনজীবনের ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করলে উনবিংশ, বিংশ শতাব্দীতেই বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কারণ তখনকার মানুষ ক্ষমতা, যৌনজীবনকেই বেশি প্রাধান্য দিতো। শাসকেরা শাসন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, যার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল একেবারেই তলানিতে। ঐতিহাসিকদের লেখার মাঝে আমরা উনবিংশ শতাব্দীর যে ইউরোপ, আমেরিকার চিত্র পাই তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না তাদের জীবনযাত্রা ছিল খুবই নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন। তখন কোনো ভ্রমণকারী যদি ইউরোপ, আমেরিকার রাস্তায় ভ্রমণ করতেন তখন তার জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল কর্দমাক্ত রাস্তাঘাট এবং প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। অনেক সিনেমায় পরিচালকেরা ইউরোপের এমন নোংরা পরিবেশ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সিনেমায় দেখানো দুর্গন্ধ তো আর পাঠক হিসেবে কিংবা কল্পনায় আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু চাইলে জানতে পারি দুর্গন্ধ এবং নোংরা পরিবেশ নিয়ে সভ্য হতে চলা মানুষদের চিন্তাভাবনা কেমন ছিল। ইতিহাস ও পরিবেশ বিষয়ক অধ্যাপক কনি চিয়াং তার বই 'দ্য নোজ নোস: দ্য সেন্স অব স্মেল ইন অ্যামেরিকান হিস্টোরিতে' দাবি করেছেন, উনবিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ শহরে কাঁচা নর্দমা, ঘোড়ার আবর্জনা, পরিত্যক্ত আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হতো। সূর্য উঠে আবার ডুবে যেত কিন্তু আমেরিকার রাস্তা থেকে ময়লা আবর্জনা এবং দুর্গন্ধ কখনোই দূর হতো না। অর্থাৎ তখনকার কথিত সভ্যসমাজ এই দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ মেনে নিয়েই জীবনযাপন করতেন।
image source:arnet
image source:arnet
তথাকথিত সভ্য আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ানদের দুর্গন্ধময় পরিবেশে জীবনযাপনের কথা উঠে এসে ইতিহাসবিদ মেলানি কিচেলের লেখায়। তার মতে, সেকালে আমেরিকানরা কসাইখানা, হাড়ের বয়লার, সার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং চামড়ার ট্যানারিকে আপত্তিকর বাণিজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছিল। কারণ এসব থেকে নির্গত দুর্গন্ধ তাদের জীবনযাপনকে কষ্টসাধ্য করে তুলেছিল। অথচ বাসার সামনে তারাই ময়লা স্তূপ করে রেখে গোটা এলাকা দুর্গন্ধময় করতেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্যারিস ছিল ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগর। ভালোবাসার নগরী হিসেবে পরিচিত প্যারিসেও তখন গোলাপের চেয়ে ময়লার দুর্গন্ধ বেশি অনুভব করা যেত। এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখা পাওয়া যায় ফরাসী ইতিহাসবিদ রবার্ট মুচেম্বলেডের বিখ্যাত বই 'স্মেলস : অ্যা কালচারাল হিস্ট্রি অব অডোরাস ইন আর্লি মডার্ন টাইমসে।' এই বইতে তিনি আধুনিক হতে চলা ইউরোপের নোংরা রাস্তাঘাট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এমনকি প্যারিসিয়ানরা পাবলিক টয়লেটের মারাত্মক দুর্গন্ধকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখতেন বলেও জানা যায় এই বইতে। প্যারিসের নাগরিকেরা বিশ্বাস করতেন এই গন্ধ তাদেরকে বায়ুবাহিত রোগবালাই থেকে রক্ষা করবে। যাইহোক, আমরা আজকে আলোচনা করব উন্নতির পথে চলা আমেরিকা এবং ইউরোপ কিভাবে এই গন্ধের কারণেই ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। মূলত সভ্যসমাজে আজ আমরা সুগন্ধির যে চর্চা দেখি সেটি অতীতেও ছিল। কিন্তু মানুষ সেটিকে চর্চাক্ষেত্রে আনেনি বলেই দুর্গন্ধকে মেনে নিয়ে বসবাস করত। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানব সুগন্ধির ব্যবহার ঠিক কতোটুক পুরোনো এবং কেন ইউরোপিয়ানরা সুগন্ধি ব্যবহার করলেও শহরের পরিবেশ নিয়ে উদাসীন ছিল।
দ্য ফাউল অ্যান্ড দ্য ফ্রেগ্রেন্ট
উপরে উল্লেখিত বই সমূহে কখনো কখনো চাঞ্চল্যকর ইতিহাসকে বড় করে দেখানো হয়েছে কিংবা বড় বিষয়গুলোকে গোপন রাখা হয়েছে যা ইতিহাসের গতিবিধি পরিবর্তন করে দেয়। যেহেতু ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাই আমরা চাই না সেটার বিকৃতি ঘটুক। পরিবেশ এবং গন্ধ নিয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকার যে ইতিহাস অতীতে ছিল তার সত্যতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যে বইটিতে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে সেটির মাধ্যমে ব্যাখা করাটাই যুক্তিসংগত। অ্যালাইন কোরবিনের লেখা 'দ্য ফাউল অ্যান্ড দ্য ফ্রেগ্রেন্ট' বইটিতে, অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর দুর্গন্ধ এবং সুগন্ধ চর্চার অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। তিনি ব্যাখা করেন কিভাবে অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে শ্রেণী চেতনার বিবর্তনকে সামাজিক তাৎপর্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সভ্য সমাজ এই শ্রেণী চেতনা কাজে লাগিয়ে ফরাসি সাধারণ নাগরিকদের দুর্গন্ধ ছড়ানোর জন্য দায়ী করেছিল। কোরবিনের বইয়ে যে গল্পটি ছিল তাতে আরো দেখানো হয়েছে রোগবালাই নিয়ে তখনকার সমাজের মানুষের ধারণা প্রকৃতপক্ষে কেমন ছিল। তারা ভাবতেন সকলপ্রকার রোগবালাই এসব দুর্গন্ধ এবং ময়লা আবর্জনা থেকেই ছড়ায়। এমনকি ডাক্তাররাও এই ধারণাটি মেনে নেন। চিকিৎসকরা রোগীদের দুর্গন্ধ এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিতেন। আর এমন রোগকে তারা 'মিয়াসমাস' নামে অবিহিত করেছিল যা কিছুটা প্লেগের মতোই। উনবিংশ শতকের শেষেদিকে জীবাণু তত্ত্ব বাস্তবায়ন হওয়া পর্যন্ত ইউরোপিয়ানদের মাঝে এই বানোয়াট মিয়াসমাস ধারণা প্রচলিত ছিল।
image source:bigthink
image source:bigthink
তখনকার প্রেক্ষাপটে মিয়াসমাস তত্ত্বটি ইউরোপের রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি পর্যন্ত, অর্থাৎ সভ্যতার প্রায় প্রতিটি অংশকে প্রভাবিত করেছিল। মধ্যযুগীয় কায়দায় সুগন্ধি তৈরি হতো প্রাণীর কস্তুরি থেকে যা সে একসময় ফুলের গন্ধ দ্বারা অদলবদল করার চেষ্টা করে ইউরোপীয়রা। লোকেরা এতটা অপরিচ্ছন্ন ছিলে যে, তারা নিজেদের শৌচাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করে বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল, ফুলের গাছগাছালি এবং ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখতেন। তারা ভাবতেন গ্রামাঞ্চলে এই সমস্ত গাছগাছালি সুগন্ধ ছড়ায় বলে শহুরে জীবনেও এসবের ব্যবহার কাজে দিবে। দ্য ফাউল অ্যান্ড দ্য ফ্রেগ্রেন্টে দেখানো হয়েছে ১৮৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের বাড়িতে লোকেরা গ্রাম থেকে সুগন্ধি ফুলের গাছ এবং শুকনো ডালপালা এনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতেন। কিন্তু এই প্রচলন খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ বড় শহরগুলোতে জীবাণুমুক্ত করার কর্মসূচী হাতে নেয় এবং দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন আবর্জনা সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা পাথুরে রাস্তাগুলোকে গ্রানাইট দিয়ে ঢেকে দেয় যাতে করে পানি জমে কর্দমাক্ত হতে না পারে। আর এমন বিপ্লবী সংস্কারের ক্ষেত্রে জনাকীর্ণ এলাকা, হাসপাতাল এলাকা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল যেহেতু এসব স্থানে স্যানিটেশন অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারের সময় ফ্রান্স শুধু শহরেই নয়, গ্রামের মানুষদের স্যানিটেশনে জোর দেয়। ইউরোপিয়ানদের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিন্তু রোগজীবাণুর প্রতি ভয় থেকে আসেনি। বরঞ্চ এসেছে দুর্গন্ধ থেকে মহামারি হতে পারে সে ভয়ে। এই জনস্বাস্থ্য উদ্যোগের নেতৃত্বদানকারীদের অধিকাংশ ছিলেন উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে গোটা সমাজের স্বাস্থ্যবিধি পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ এখানে শুধু দুর্গন্ধ থেকে রোগবালাই ছড়ায়, এই ধারণা থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় সংস্কারের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র একপ্রকার মিথ্যা বিশ্বাস তাদের স্যানিটেশন নিশ্চিত করেছিল! কোনোপ্রকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখা না থাকা স্বত্ত্বেও তারা দুর্গন্ধের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তা বিফলে যায়নি। বরঞ্চ তাদের আরো বেশি সভ্য হিসেবে গড়ে তুলেছিল। মূলত এই বইতে দেখানো হয়েছে কিভাবে গন্ধের ভয়াবহতা বুঝে মানুষ নির্বুদ্ধিতা থেকে স্যানিটেশনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।
দুর্গন্ধ ছাড়িয়ে শুধু সুগন্ধ
আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি কিভাবে দুর্গন্ধ নিয়ে ইউরোপিয়ান মানুষ উনবিংশ শতকে বিপাকে পড়েছিল। এমনকি বুঝতে পেরেছি কিভাবে দুর্গন্ধ থেকে ছড়ানো রোগের ভয়ে তারা গোটা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। কিন্তু অ্যাংলিয়া রুস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম টুলেট এই বিষয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তার মতে আধুনিক মিডিয়া এবং গবেষকরা গত কয়েক শতাব্দীর দুর্গন্ধ নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করে। সেকালের দুর্গন্ধ নিয়ে মানুষের মধ্যে এই সময়ের এমন ধারণাকে জেনোফোবিয়ার কিছুটা বিকৃত রূপ বলে অবিহিত করেছেন টুলেট। কারণ ফ্রান্স তথা ইউরোপ বিরোধী অনেক স্কলার, অধ্যাপকই সেখানকার সমৃদ্ধ ইতিহাসের চেয়েও প্রচলিত দুর্গন্ধ নিয়ে বেশি আলোচনা করে। অধ্যাপক টুলেট আরো একটি দারুণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকের দুর্গন্ধ সর্বব্যাপী প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই ধারণার প্রতি আধুনিক যুগের মানুষদের অতিরিক্ত বিরূপতা সুগন্ধ কিংবা এর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বাধা দেয়। তার মতে, মানুষ শুধুই অতীতকে ঘৃণার সার্কাসে পরিণত করতে চায়। অথচ অতীতের অনেক অপসংস্কৃতি আমাদেরকে প্রতিনিয়ত শুধরে দিচ্ছে, করছে আলোকিত! আর অতীতের দুর্গন্ধ নিয়ে আলোচনা এতটাই ব্যাপক যে ঘ্রাণের সুন্দর দিক বা সুগন্ধ নিয়ে তেমন আলোচনাই হচ্ছে না।
image source:smarthistory
image source:smarthistory
যদিও গন্ধ বা ঘ্রাণ নিয়ে মানুষের ইতিবাচক ধারণা নিয়ে সাম্প্রতিকালে ব্যাপক গবেষণা চলছে। তবে বিষয়টি কঠিন কারণ নেতিবাচক ইতিহাস নিয়ে বেশি আলোচনা করতে গিয়ে এই বিষয়ের তালগোল ঠিক রাখেনি ইতিহাসের প্রবাহমাত্রা স্রোত। আশার কথা হলো আজকার ধূপ বার্নার, সুগন্ধি ফ্লাস্ক, রান্নার পাত্র, মমিকৃত দেহাবশেষ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করতে বায়োমোলিকুলার প্রকৌশলের দ্বারস্থ হচ্ছেন গবেষকরা। এসব গবেষণা এতই অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে যা পূর্বের নিউ ইয়র্কের লোকেরা বাড়িঘরে দুর্গন্ধ দূর করতে যেসব চর্চা শুরু করেছিলেন সেসব থেকে কখনোই পাওয়া যেত না। ইয়েমেনে পাওয়া মধ্যযুগীয় একটি রেজিনে বায়োমোলিকুলার পরীক্ষার পর দেখা গেছে যে পণ্যটি স্থায়ীভাবে চাষ করা হয়নি। বরঞ্চ মাদাগাস্কার কিংবা আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হয়েছিল! এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ নিঃশ্বাস সতেজ রাখতে সুগন্ধি গাছের বাকলকে রাসায়নিক পরিবর্তন করেছিল। পার্থক্য হলো এই বিষয়গুলো ইউরোপে তখনও পৌঁছায়নি কিংবা ইউরোপীয়রা সেগুলো গ্রহণ করেনি। এসব গবেষণা আরো প্রমাণ করে যে, ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে যে ফ্রান্স এবং তার ইতিহাস বিদ্যমান ছিল সেটি বিশেষ সুগন্ধি ও তাদের বিপণন নিয়ে মোটেও ভাবেনি। আমেরিকানরাও এই বিষয়ে মনোযোগ দেয়নি কারণ তাদের মূল তৎপরতা ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং যৌনজীবনকে ঘিরে। অথচ আমেরিকা অঞ্চলেই অ্যাজটেক যুগে সুগন্ধি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
রোমান অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সুগন্ধির ব্যবহার
বিগত শতাব্দীতে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন এবং ঘ্রাণের প্রতি মানুষের ধারণা সত্যিকারার্থে বোঝা গেছে পূর্বের আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু মানুষ যে হাজার বছর আগে থেকেই সুগন্ধি চর্চা করছে সে ব্যাপারে প্রমাণ পেতে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে পারে সবথেকে শক্ত প্রমাণ বা উদাহরণ। ১৪৮৫ সালে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক রোমের ভায়া অ্যাপিয়ায় কাজ করার সময় একটি পুরোনো রোমান কবর খুঁজে পান। তারা ভুলক্রমে কবরের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলেন। সেখান থেকে কফিন উদ্ধার করে তারা। মৃত ব্যক্তির কফিনে লোবান, ঘৃতকুমারী এবং দেবদারু তেল ও টারপেন্টাইনের মারাত্মক সুগন্ধ অনুভব করেন। এই ঘটনার পর রোমানদের ইতিহাস নিয়ে গবেষনারত গবেষকদের ধারণা অনেকটাই পাল্টে যায়। কারণ হাজার বছর আগে থেকেই মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাতে দুর্গন্ধ রোধ করা যায় সেজন্য সুগন্ধি ব্যবহার করতেন রোমানরা। এমনকি সে সময়ের হিসেবে এই কাজ যথেষ্ট ব্যয়বহুল হলেও সেটি করতেন মৃতের আত্মীয়রা।
image source:thoughtout
image source:thoughtout
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রোমানরা মৃত ব্যক্তিকে শেষ বিদায়ের পূর্বে নিজ ঘরে ধূপ, সুগন্ধি মশলা এবং মলম দিয়ে ধোয়ামোছা করত। যদিও নির্মাণ শ্রমিকদের ঘটনা বাদে এর পেছনে শক্তপোক্ত কোনো প্রমাণ দাঁড় করাতে পারেননি তারা। যারা বিশ্বাস করেন এমন প্রথা তাদের মতে সুগন্ধি সমূহ মৃতদেহের অভ্যন্তরে কখনোই দূষিত হতে দিবে না। আর এটি শুধু সাময়িকের জন্য না, মহাকাল ধরেই সুগন্ধি তাদের রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস ছিল রোমানদের। আবার যে বাড়িতে মৃতব্যক্তি ছিল সে বাড়ির বাহিরে সাইপ্রাস গাছের ডালপালা প্রতিস্থাপন করার মধ্যদিয়ে নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করার প্রবণতাও ছিল রোমানদের মধ্যে। ইতিহাস থেকে জানা যায় তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সুগন্ধির ব্যবহার শুধু কফিনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা যখন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলত তখন মিষ্টি গন্ধযুক্ত কাঁঠ, জাফরান এবং দারুচিনি ব্যবহার করত যাতে করে সুভাষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদ ডেভিড ক্ল্যান্সির মতে, মৃতদের সুগন্ধি দেয়া প্রাচীন রোমানদের নিকট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা তারা প্রায়শই সমাজে নিয়মকানুন হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছিল। 
image source: britannica
image source: britannica
আবার এমন বিষয়গুলোর বিরোধিতা করা রোমান ব্যক্তিবর্গ কম ছিলেন না। রোমান সিনেটর কেটো দ্য এল্ডার তার ভাইকে পরিত্যাগ করেছিলেন কারণ তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সে সময় অন্যান্য রোমানদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন এসকল সুগন্ধি শুধুমাত্র দেবতাদের জন্য সৃষ্টি। কিন্তু যে ভাইকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন সে ভাইয়ের মৃত্যুর পর কেটো বিপুলপরিমাণ ধূপ সংগ্রহ করেছিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। শেষমেশ বোঝা গেলো, মানুষ সুগন্ধি গ্রহণ করতেন আবার শেষবিদায়ে সঙ্গে দিতেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই চর্চাকে প্রচলনে রূপ দিতে পারেনি তারা। আবার মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকায় সভ্যতা সৃষ্টি হওয়ার সময়গুলো কিছু কিছু বিষয়ে প্রভাবিত হয়েছিল যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সকল বিষয় ইউরোপের মানুষ সহজভাবে নিতে পারেনি। যদি গ্রহণ করতে পারত তাহলে আমরাও তাদের অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময় পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করার বদলে তাদের সভ্য সমাজ নিয়েই আলোচনা করতাম।

তথ্যসূত্র: বিগথিঙ্ক
আন্তর্জাতিকইউরোপযুক্তরাষ্ট্রইতিহাস
আরো পড়ুন