ইতিহাসের নিরব সাক্ষী 'কার্জন হল' এর লাল রঙ কেনো?
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
কার্জন হল উপমহাদেশের মধ্যে ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। ভবনটির সাথে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ ১১৬ বছরের ইতিহাস। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের নিরব সাক্ষী এই স্থাপনাটি। কার্জন হল যেন এক নিরব ভাষা সৈনিক এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা।
এ স্থাপনাটি শুধুমাত্র একটি ইট পাথরের ভবনই নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের মানুষের আবেগ। কার্জন হলের ইতিহাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও পুরনো। অসাধারণ নির্মাণশৈলীর এই স্থাপনাটি যেকোনো ভাবুক ব্যক্তিকে দ্বিতীবার তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করে। চলুন আজ আমরা কার্জন হলের সেকাল-একাল নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করব।
কার্জন হলের সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গ করার পরিকল্পনা করছিল তখন স্বাভাবিক ভাবেই ঢাকা হওয়ার কথা ছিল পূর্ব বাংলার রাজধানী। তখন ঢাকাতে তেমন কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি স্থাপনা ছিলনা। ঢাকার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ব্রিটিশরা ঢাকাতে বেশকিছু স্থাপনা নির্মিণের জন্য অনুমোদন করে। তারমধ্যে কার্জন হল অন্যতম।
বর্তমানে কার্জন হল হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান অণুষদের কিছু শ্রেনীকক্ষ ও পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তাছাড়া ১৯০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্ত্বিত্বই ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯২১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার অনেক পরে।
বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য রমনা এলাকার যেসব ইমারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় কার্জন হল তার মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিক দানী লিখেছেন, 'কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল টাউন হল হিসেবে'। কিন্তু শরীফউদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেছেন এ ধারণাটি ভুল। তার মতে এটি নির্মিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে। এবং নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার। ১৯০৪ সালের ঢাকা প্রকাশ লিখেছিল-
ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ডাক্তার রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমন উপলক্ষে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এ অঞ্চলে লর্ড কার্জন বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে 'কার্জন হল' নামে একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে, ঢাকা কলেজের ক্লাস নেয়া হতে থাকে কার্জন হলে। পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কার্জন হল অন্তর্ভুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য, যা আজ অবধি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সেসময় ঢাকার প্রধান রেল স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়াতে। ঢাকা তখন নিতান্তই একটি মফস্বল, বাংলার রাজধানী নয়। আয়তনেও খুব বেশি বড় ছিল না। তখন বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্তই ছিল ঢাকার বিস্তৃতি। কয়েক দশকের মধ্যে উত্তর দিকে ঢাকা শহরের পরিধি বাড়তে বাড়তে উত্তরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
১৯০৪ সালে ট্রেনে চড়ে ভাইসরয় লর্ড কার্জন এবং লেডি কার্জন এসেছিলেন এই ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। লর্ড কার্জনের আগমন উপলক্ষে সেদিন ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে উপচে পড়ছিল ভিড়। তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু হেন্ডারসন লেথ ফ্রেজার নিজ হাতে ফুলের মালা পরিয়ে লর্ড কার্জনকে সংবর্ধনা জানান। এরপর লর্ড কার্জনকে নিয়ে যাওয়া হয় রমনায়। ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি 'কার্জন হল' নামে একটি টাউনহলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমণ ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ঢাকার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে এই ঘটনাটি বার বারই সামনে আসে। পিছিয়ে পড়া পূর্ব বাংলার মানুষ সেবারই সর্বপ্রথম কোনো ভাইসরয়ের সাক্ষাৎ পায়। লর্ড কার্জনের আগমণের পর থেকেই উপমহাদেশে ঢাকার ভাবমূর্তি এক অনন্য উচ্চতায় উঠে আসে। মাত্র দুই বছর পরই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকা পুর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিখ্যাত আলোকচিত্রী ফ্রেজ ক্যাপের তোলা একটি ছবি প্রমাণ করে লর্ড কার্জনের আগমণ উপলক্ষ্যে সেদিন ঢাকায় কেমন উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
কার্জন হলের সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। মূলত কার্জন হল নির্মিতই হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ্যে। ১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল।
১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।
অবশেষে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫০৪ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ্য ছিল মুসলিম এবং ১ কোটি ২০ লক্ষ্য ছিল হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে।
রাজ্যটি কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে। সাথে সাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এলেই নাম চলে আসে ঐতিহাসিক কার্জন হলের। ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত এ ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ ও মুগল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ। এটি বিশেষ করে পরিলক্ষিত হয় অভিক্ষিপ্ত উত্তর দিকের সম্মুখভাগের অশ্বখুরাকৃতি ও খাঁজকাটা খিলানের মাঝে।
ঐতিহ্য শিল্পের সাথে আধুনিক কারিগরি বিদ্যার মিশ্রিত রীতি এবং মুগল ধাঁচের খিলান ও গম্বুজে বিধৃত, সম্ভবত পাশ্চাত্য থেকে ইসলামিক স্থাপত্য জগতে প্রবেশ করেছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা পরিহার করে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে নেওয়ার পর মুগল যোগসূত্র রক্ষা করে এর বৈধতা প্রদানের প্রয়াস এতে পরিলক্ষিত হয়।
১৯০৪ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন এই হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং তারই নামানুসারে এ ভবনের নাম হয় 'কার্জন হল'। এ ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ ও মুগল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ; আংশিকভাবে মুসলিম স্থাপত্যরীতিও অনুসরণ করা হয় এতে। ভবনের বহির্পৃষ্ঠে কালচে লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক স্থাপত্য বিদ্যা এবং মোগল কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এর খিলান ও গম্বুজগুলো।
কারুকার্য খচিত বিশাল এ ভবনে রয়েছে একটি বিশাল কেন্দ্রীয় হল। এর বাইরের রঙ লাল। ভবনটির সামনে রয়েছে একটি প্রশস্ত বাগান, যেখানে সবুজের বুক চিরে পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে গেছে একটি রাস্তা। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর যার পশ্চিম পারে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলের মূল ভবন। দ্বিতল এ ভবন ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত।
পুরো ঢাকায় কার্জন হলের সমকক্ষ ঐতিহাসিক কোন স্থাপনা খুব সম্ভবত আর নেই। কার্জনই একমাত্র স্থাপনা যা তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো তার রূপরস ধরে রেখে আছে। বিগত এক শতাব্দীর বেশী সময় ধরে এই স্থাপনাটি যেন চির যৌবনা হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কার্জন হলের ভেতরে রয়েছে বিশাল হলরুম যা বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কার্জনের রঙ লাল কেন? এমন প্রশ্ন শুনতে অবান্তর মনে হলেও কার্জন হলের রঙ লাল হওয়ার পেছনে প্রচ্ছন্ন একটি কারণ রয়েছে। এই স্থাপনায় ইউরোপীয় ও মুঘল স্থাপত্যরীতির সম্মীলন ঘটেছে। মুঘল সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির দিওয়ান-ই-খাসের অনুকরণে লাল বেলেপাথরের পরিবর্তে তৈরি এ স্থাপনার মাধ্যমে ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছে উপমহাদেশে তাদের অবস্থান আকবরের মত। কেননা একমাত্র আকবরকেই তারা শ্রেষ্ঠ পরিশীলিত মুঘল শাসক হিসেবে স্বীকার করত।
বাংলার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের নিরব সাক্ষী কার্জন হল। ভাষা আন্দোলনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়ে কার্জন হল সাক্ষাত সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা না না বলে প্রতিবাদ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের সাথে এভাবেই জড়িয়ে যায়।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এই হলের ভূমিকা অপরিসীম। তৎকালীন সময়ে সকল আন্দোলন সংগ্রামের আতুঁড়ে ঘর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হচ্ছে কার্জন হল। একইভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও কার্জন হলের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা এ স্থাপত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনার্থীর জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। নিকট-সুদূর থেকে প্রতিদিনই এখানে মানুষ এসে আড্ডা দেয়, জমায়েত হয় নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকা এ ভবনের পাশেই রয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হল ও শহীদুল্লাহ হল; মাঝে এক মনোরম পুকুর স্থাপত্যটিকে দিয়েছে আলাদা আবেদন।
Reference:
- https://tinyurl.com/y4fd2mzq
- https://tinyurl.com/y36x9qss
- https://tinyurl.com/yyumefuk