কাবা'র গিলাফ পরিবর্তন: যেভাবে হয়ে উঠলো হজের রীতি
ধর্ম
কাবা'র গিলাফ পরিবর্তন: যেভাবে হয়ে উঠলো হজের রীতি
প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৯ তারিখ তারিখ আরাফা প্রাঙ্গণে হাজিদের অবস্থানকালে পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। হাদিসে বর্ণনা মতে, নবম হিজরিতে রাসুল (সা.) মক্কা বিজয় করে হজ পালনকালে আরাফার দিন (৯ জিলহজ) সাদা রঙের ইয়ামেনি চাদর দিয়ে পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ পরিবর্তন করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর এ দিন কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। 
গিলাফ কী?
কাবাকে আবৃত করে রাখা কাপড়টিকে বলে কিসওয়া বা গিলাফ। প্রতি বছর ৯ জিলহজ হজের দিন কাবা শরিফে পুরোনো গিলাফ পরিবর্তন করে নতুন গিলাফ পরানোর রেওয়াজ রয়েছে।হাজিরা আরাফাত থেকে ফিরে এসে নতুন গিলাফ দেখে রোমাঞ্চিত হন। তবে পুরাতন গিলাফ কেটে বিভিন্ন মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানদের উপহার দেওয়া হয়। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে উপহার হিসেবে পাওয়া পবিত্র কাবার গিলাফের একটি অংশ বাঁধাই করে রাখা আছে। 
কখন থেকে এই রীতি?
পবিত্র কাবাঘরকে গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদন কখন এবং কার উদ্যোগে শুরু হয় সেই সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয়, হজরত ইসমাইল (আ.) প্রথম কাবাঘরকে গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদন করেন। ভিন্ন আরেক বর্ণনায় আছে, নবী করিম (সা.)-এর পূর্বপুরুষ আদনান ইবনে আইদ কাবাঘরে প্রথম গিলাফ দেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী, হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু বকর আসাদ কাবাঘর গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদনকারী প্রথম ব্যক্তি। এ ঘটনা হিজরতের ২২০ বছর আগের। এরপর থেকে মক্কার স্থানীয়দের পাশাপাশি, বিভিন্ন গোত্রপতি, আশপাশের রাজা-বাদশাহরা কাপড় দিয়ে কাবাঘর আচ্ছাদন করতে থাকেন এবং তা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়। নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাবা শরিফে গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের জননী নুতাইলা। হাদিসে এসেছে, নবম হিজরিতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয় করে হজ পালনকালে আরাফার দিন (৯ জিলহজ) সাদা রঙের ইয়ামেনি চাদর দিয়ে কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করেন। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) কাবায় সাদা গিলাফ পরিয়েছেন।তবে ওই সময় গিলাফ বদলানো হতো না। পুরনো গিলাফের ওপর নতুন গিলাফ পরানো হতো। কোনো কোনো সময় এক-দুই বছর পুরনো গিলাফ ঝুলত, আবার কোনো কোনো সময় বছরে একাধিকবার নতুন গিলাফ দেওয়া হতো। আব্বাসীয় খলিফা আল আব্বাস আল মাহদি ১৬০ হিজরিতে হজ পালন করতে গিয়ে দেখেন পুরনো গিলাফের ভাড়ে কাবার দেয়াল ভেঙে পড়ার উপক্রম, তখন তিনি পুরনো সব গিলাফ অপসারণ করে নতুন গিলাফের ব্যবস্থা করেন। একসময় বাইরের মতো ভেতরেও গিলাফে আবৃত করা হতো কাবার দেয়াল, যা এখন করা হয় না।  
গিলাফের রং কালো কেন?
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.)-এর সময় কাবার গিলাফ সাদা ও লাল রঙের ডোরাকাটা ইয়ামানি কাপড় দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছিল। অতঃপর আবু বকর, উমর, উসমান (রা.)-এর সময়ে তা সাদা কাপড় দ্বারা আবৃত করা হয়। ইবনে জুবাইর (রা.)-এর সময় লাল ব্রকেড কাপড় দিয়ে আবৃত করা হয়। আব্বাসি যুগে কখনও সাদা কখনও লাল কাপড় দ্বারা আবৃত করা হত। সেলজুকি শাসনামলে তা হলুদ কাপড় দিয়েও আবৃত করা হয়। আব্বাসি খলিফা নাসির তা কালো কাপড় দ্বারা আবৃত করে। এরপর থেকে কাপড়ের এ রং এখনও অব্যাহত। সেন্টার অফ মক্কাহ হিস্টরির প্রধান ড. ফাওয়াজ আল দাহাজ বলেন, কাবা ঘর কখনও সাদা, কখনও লাল, কখনও কালো রঙের কাপড় দিয়ে আবৃত করা হয়েছে। তবে সব যুগেই অর্থনৈতিক অবস্থার নির্ভর করে কাপড়ের রং নির্ধারণ করা হত। কাবার গিলাফে আল্লাহতায়ালার গুণবাচক বিভিন্ন নাম ও কোরআনে কারিমের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফি করা হয়। এসব কারুকাজ করা হয় সোনালি হরফে। পুরো গিলাফে জলছাপে লেখা আছে আল্লাহর গুণবাচক নাম ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’, কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’, ‘ইয়া আল্লাহ’ ইত্যাদি। 
কোথায় তৈরি হয়?
১৯৬২ সাল পর্যন্ত কাবাঘরের গিলাফ মিসর থেকে আসত। মাঝে ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ব্যবহ্রত কাবার গিলাফ সৌদি আরবের মক্কায় তৈরি হয়েছিল। ১৯৩৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত মিসর ফের সেই দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমানে সৌদি আরবে তৈরি হওয়া এই গিলাফও মিসরের অনুকরণে তৈরি হচ্ছে। বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সৌদ মক্কা-মদিনার দুই মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ১৩৪৬ হিজরিতে কাবার গিলাফ তৈরির জন্য একটি বিশেষ কারখানা স্থাপনের নির্দেশ দেন। ওই বছরের মাঝামাঝিতে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করে মক্কার দক্ষ শিল্পীর মাধ্যমে তা সুন্দর নকশায় সুসজ্জিত করে কাবা শরিফ আচ্ছাদিত করা হয়। পরে ১৩৮১ হিজরিতে সৌদি হজ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষ সৌদি কারিগর দ্বারা রেশমি ও সোনালি সুতো দিয়ে গিলাফ তৈরি করে কাবার গায়ে পরিধানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩৮২ হিজরিতে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সৌদ। তার নির্দেশক্রমে গিলাফ বা কিসওয়া তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয় পবিত্র কাবা থেকে চার কিলোমিটার দূরে উম্মুল জুদ এলাকায়। এটি তৈরিতে ১ কোটি ৭০ লাখ সৌদি রিয়াল ব্যয় হয়। কারখানাটি ছয়টি অংশে বিভক্ত—বেল্ট, হস্তশিল্প, যান্ত্রিক, ছাপা, রং ও অভ্যন্তরীণ পর্দা বিভাগ। বর্তমানে এতে ২৫০ জনের বেশি শিল্পী নিয়োজিত আছেন। আগে প্রত্যেক বছর কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হতো না। ১৪১৭ হিজরি থেকে প্রতি বছর কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। 
গিলাফ তৈরিতে কত সময় লাগে?
কাবা শরিফের দরজা ও বাইরের গিলাফ দুটোই মজবুত রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। গিলাফের মোট পাঁচটি টুকরো বানানো হয়। চারটি টুকরো চারদিকে এবং পঞ্চম টুকরোটি দরজায় লাগানো হয়। টুকরোগুলো পরস্পর সেলাইযুক্ত।এর মোট আয়তন ৬৫৮ বর্গমিটার। প্রতিটি থান এক মিটার লম্বা, ৯৫ সেন্টিমিটার চওড়া। এগুলো পরস্পরের সঙ্গে সেলাই করা। প্রতিবছর দুটি করে (একটি সতর্কতামূলক) গিলাফ তৈরি করা হয়। হাতে তৈরি করতে সময় লাগে আট থেকে নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। উম্মুল জুদ কারখানায় মদিনায় হুজরায়ে নববীর গিলাফও তৈরি করা হয়।
খরচ কেমন?
প্রতি বছর গিলাফ তৈরিতে ১২০ কেজি স্বর্ণ ও ১০০ কেজি রূপার প্রয়োজন হয়। এগুলো আনা হয় জার্মানী থেকে। একেকটি কোরআনের আয়াত এমব্রয়ডারি করতে ৬০ দিন সময় লেগে যায়। সিল্কের কাপড় লাগে সবমিলিয়ে প্রায় ৬৭০ কেজি, এগুলো আনা হয় ইতালি থেকে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে খরচ পড়ে প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার। দুই শতাধিক শ্রমিক সারাবছর কাবার গিলাফ তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকেন। গিলাফটি খুব টেকসই ও মানসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়। যেন রোদ-বৃষ্টিতে গিলাফ নষ্ট না হয়।
ধর্মইসলামসৌদি আরবহজ
আরো পড়ুন